পুরুষ-খৎনার ইতিহাস
খৎনার প্রাচীনতম দালিলিক প্রমাণ এসেছে প্রাচীন মিশর থেকে। খৎনা বা ত্বকচ্ছেদ খুবই সাধারণ প্রথা ছিল প্রাচীন সেমেটিক জাতির মধ্যে। অ্যালেক্সান্ডার দি গ্রেট-এর অভিযানের পর থেকেই, গ্রিকদের খৎনার প্রতি ঘৃণার মনোভাবের কারণে (তারা মনে করত খৎনা করা লিঙ্গত্বক-বিহীন পুরুষ সত্যিকারভাবেই সম্পূর্ণ নগ্ন) অনেক গোষ্ঠী খৎনা পালন বন্ধ করে দেয়।
খৎনার প্রাচীন ভিত্তি উপ-নিরিক্ষিয় আফ্রিকার অনেক জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে এবং এখনও কিশোর বয়সী ছেলেদের খৎনা করা হয় যাতে করে তাদেরকে প্রাপ্তবয়স্ক ও যোদ্ধায় রুপান্তর হওয়াকে চিহ্নিত করা যায়।[1] পুরুষ খৎনা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে অনেক প্রাচীন প্রথা হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে।[2][3]
উৎপত্তি

খৎনার উৎপত্তি নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় যে, কিশোরদের প্রাপ্তবয়স্কে উন্নীত হওয়ার সময় তাদেরকে খৎনা করা হত যা তাদের পুরুষত্বের চিহ্ন হিসেবে দেখা হত এবং পুরুষের যৌন-আনন্দ হ্রাস করার জন্য খৎনা করা হত। নারী-খৎনার সাথে এর মিল আছে, কারণ নারী-খৎনাও করা হত নারীদের যৌন আনন্দ ধ্বংস করার জন্য যাতে করে তারা এক পুরুষের বাইরে যৌন কর্ম না করে। খৎনা আরও কয়েকটি কারণে করা হত, যেমনঃ পুরুষের লিঙ্গকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উপায় হিসেবে (কারণ সেমেটিক জাতিরা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে বাস করত এবং সেখানে পরিষ্কার হওয়ার ও গোসল করার পানির মারাত্মক সংকট ছিল।), পুরুষের হস্তমৈথুনের অভ্যাস দমন করার জন্য, শত্রুদের অপমান করার জন্য এবং দাসদেরকে চিহ্নিত করার জন্য খৎনা করা হত, বাড়তি যৌন আনন্দ থেকে পুরুষকে বঞ্চিত করার জন্য খৎনা করা হত।[4][5][6][7][8]
আফ্রিকা
আফ্রিকার অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা উপজাতীয় প্রথা হিসেবে খৎনা/ ত্বকচ্ছেদ করে থাকে।
প্রাচীন বিশ্ব

প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন দেয়াল মন্দিরে খৎনার বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া যায়। [9]

খৎনা সেমেটিক জাতিদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল, মুলত এই কারণে যে, মরুভূমির অঞ্চলগুলিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার মত পানি পাওয়া জেট না। তাই সেমেতি জাতিরা তাদের লিঙ্গকে পরিষ্কার রাখার জন্য খৎনা করত। এটি পরবর্তীতে সেমেটিক জাতি গোষ্ঠীর লোকজন তাদের ধর্মশাস্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করে ( যেমন- ইহুদী ও ইসলাম ধর্ম)।
আদিপুস্তক (বাইবেল)-এ খৎনাকে ঈশ্বরের সাথে আব্রাহাম একটি চুক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে,[Gen 17:10] কিন্তু, অধিকাংশ পণ্ডিতই এই ঐতিহাসিক মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ বিজ্ঞান অনুযায়ী সৃষ্টিতত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং ইতিহাসবিদরাও আব্রাহামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। আব্রাহাম কেবলই বাইবেলীয় একটি রূপকথার চরিত্র ছাড়া আর কিছু নন। পৃথিবীর প্রথম ইতিহাসবিদ হেরোডেটাস এর ইতিহাস অনুযায়ী, খৎনা প্রথা প্রথম চালু হয় মিশরীয়দের মধ্যে, তাদের দাস প্রথা চালুর সময়ে। ১৯ শতকের একটি নৃতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায় যে, খৎনা ছিল অনেক সেমিটিক গোত্র সহ ইহুদি, আরব এবং ফিনিশীয় জাতির মধ্যে একটি সাধারণ উপজাতীয় প্রথা। হযরত মূসা খৎনা করেন নি, তার এক ছেলেও অচ্ছিন্নত্বক ছিল। অতঃপর মূসার স্ত্রী তাদের ছেলের খৎনা করেন, যখন ঈশ্বর মূসাকে হত্যা করার হুমকি দেন।
হেলেনিয় ও ইহুদী সভ্যতা

গ্রীকদের কাছে খৎনা বা লিঙ্গত্বকচ্ছেদন-কে বর্বরোচিত ও ঘৃণ্য কাজ বলে মনে করত। কারণ এতে যৌনাঙ্গের সংবেদনশীল অংশ কেটে ফেলা হয়। গ্রীকদের ভাস্কর্যগুলোতে অচ্ছিন্নত্বক পুরুষদের মূর্তি গড়া হত। হেলেনিয় সভ্যতার সময়ের যেসব গোষ্ঠীর লোকজন খৎনা পালন করত তারাও খৎনা করা ছেড়ে দিল।
ইহুদী রাজা জন হাইরকানুস হেলেনিয় সভ্যতার লোকদের জোর করে খৎনা করিয়ে ইহুদী ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে।

খ্রিস্টান-ধর্মে পতন

- থমাসের সুসমাচার অনুযায়ী, যীশু বলেন,
- "তার শিষ্যরা তাঁকে বললেন, "ত্বকচ্ছেদ দরকারী কি না?" তিনি তাদের বললেন, "যদি এটা দরকারী হত, তাদের বাবা এমন সন্তান জন্ম দিত, যারা ইতিমধ্যে মায়ের উদর থেকেই ত্বকচ্ছেদ করা। বরং, প্রকৃত ত্বকচ্ছেদ হচ্ছে আত্মার ত্বকচ্ছেদ, যা প্রত্যেক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লাভজনক।"" SV [10]
ইউরোপীয়রা, একমাত্র ইহুদীরা বাদে, পুরুষ-খৎনা করত না। একটি দুর্লভ ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে ভিসিগথিক স্পেনে, যেখানে সশস্ত্র রাজা ওয়াম্বা প্রত্যেক ব্যক্তির খৎনার নির্দেশ দেন, যারা সাধারণ জনগণের উপর নৃশংস আচরণ করেছিল। [11]
১৮দশ শতাব্দীর মধ্যে এডওয়ার্ড গিবন "বাতিকগ্রস্ত অঙ্গহানি" বলে উল্লেখ করেন, যা শুধুমাত্র ইহুদী ও তুর্ক জাতির লোকেরা চর্চা করে এবং তিনি একে, "একটি বেদনাদায়ক এবং প্রায়ই বিপজ্জনক ধর্মীয়-আচার" বলে উল্লেখ করেন। (R. Darby)[12]
ইংরেজি-ভাষী বিশ্বে খৎনার পুনরাবির্ভাব
নেতিবাচক মনোভাবের পরও ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলোতে খৎনা বা ত্বকচ্ছেদের নিয়ম আবার ফিরে আসে।
মেডিক্যাল উদ্বেগ

জনাথন হাচিন্সন, প্রথম চিকিৎসক যিনি খৎনাকে সমর্থন করেন। তিনি তার গবেষণা পত্রে উল্লেখ করেন যে, খৎনা করা হলে সিফিলিস ও অন্যান্য যৌন রোগ হ্রাস পায়। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসকরা তার দাবির কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পান নি, এবং হাচিন্সনের গবেষণা পত্রে উপস্থাপিত তথ্যাদি বানোয়াট বলে তারা সন্দেহ পোষণ করেন।[13][14]
পরবর্তী পঞ্চাশ বছর হাচিন্সন খৎনার পক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালান, এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে পেনাইল ক্যান্সার প্রতিরোধ কেবল খৎনার মাধ্যমেই সম্ভব। হাচিন্সন ছিলেন আবার ভিক্টোরীয় নীতিবাগীশ, এবং ভিক্টোরীয় রক্ষনশীলতার কারণেই তিনি হস্তমৈথুনকে পছন্দ করতেন না। হস্তমৈথুনের প্রতিষেধক হিসেবে তিনি খৎনাকে অপরিহার্য বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, "আমি বিশ্বাস করি খৎনা হস্তমৈথুনের অভ্যাস সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়।" কিন্তু হস্তমৈথুন আজ পর্যন্ত পুরুষের মাঝে চর্চা হয়ে আসছে, খৎনা কোনভাবেই এটিকে বন্ধ করতে পারে নি ও পারবেও না। [15]
হস্তমৈথুন উদ্বেগ

ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলে যৌনতার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব থেকেই হস্তমৈথুন বন্ধ করার জন্য খৎনা করার পরামর্শ দেওয়া হত। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, হস্তমৈথুন কোন মানসিক ব্যাধিও নয়, কোন অপরাধ বা পাপ নয়। খৎনা করে হস্তমৈথুনকে বন্ধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়, কারণ লিঙ্গের অভ্যন্তরীণ শিরা ও ধমনীগুলো সচল থাকে এবং বার বার যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ও পুরুষরা হস্তমৈথুন করে থাকে।
আরও দেখুন
- নবজাতক সুন্নতএর জৈবনৈতিকতা
- শিশুদের অধিকার
- সুন্নত বিতর্ক
- নৈতিকতা এর সুন্নত
- খৎনার ব্যাপ্তি
- সহিংসতার বিরুদ্ধে পুরুষদের
তথ্যসূত্র
- Marck, J (১৯৯৭)। "Aspects of male circumcision in sub-equatorial African culture history"। Health Transit Review। 7 (supplement): 337–360। PMID 10173099।
- Morrison J (১৯৬৭)। "The origins of the practices of circumcision and subincision among the Australian aborigines"। The Medical Journal of Australia। 1 (3): 125–7। PMID 6018441।
- http://pacifichealthdialog.org.fj/Volume209/No20120_20Emergency20Health20In20The20Pacific/Original20Papers/Attitudes20of20Pacific20Island20parents20to20circumcision20of20boys.pdf%5B%5D%5B%5D
- "SHEM"। The Jewish Encyclopedia। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১২-১৭।
- Amin Ud, Din M (২০১২)। "Aposthia-A Motive of Circumcision Origin"। Iranian Journal of Public Health। 41: 84। PMID 23193511। পিএমসি 3494220
। - Ronald Immerman and Wade Mackey (১৯৯৭)। "A Biocultural Analysis of Circumcision"। Social Biology। 44 (3): 265–275। doi:10.1111/j.1467-9744.1976.tb00285.x। PMID 9446966।
- Robert Darby (২০০৩)। "Medical history and medical practice: persistent myths about the foreskin"। Medical Journal of Australia। 178 (4): 178–9। PMID 12580747।
- "Policy Statement On Circumcision" (PDF)। Royal Australasian College of Physicians। সেপ্টেম্বর ২০০৪।
- Gollaher 2000, পৃ. 2
- "Archived copy"। ১৩ আগস্ট ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০২-০৮।
- Julian of Toledo। Historia rebellionis Paulli adversus Wambam Gothorum Regem (Latin ভাষায়)। পৃষ্ঠা 10। reprinted in Jacques Paul Migne, সম্পাদক (১৮৬২)। Patrologiæ cursus completus, seu bibliotheca universalis, integra, uniformis, commoda, oeconomica, Omnium SS. Patrium, Doctorum scriptoriumque, eccliasticorum। পৃষ্ঠা 771–774।
- Robert Darby। "A short history of the world's most controversial surgery"। Circumcision Information Australia। ১৯ জুলাই ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১০-০৭।, a review of David L. Gollaher (২০০০)। Circumcision: A history of the world's most controversial surgery। New York: Basic Books। আইএসবিএন 0-465-04397-6।
- "The crotchets of Sir Jonathan Hutchinson"। History of Circumcision। ২ জুন ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ এপ্রিল ২০১৮।
- Epstein E (১৮৭৪)। "Have the Jews any Immunity from Certain Diseases?"। Medical and Surgical Reporter। Philadelphia। XXX: 40–41।
- "On circumcision as a preventive of masturbation", Archives of surgery, Vol. II, 1890, p. 267-9
- Hugh O'Donnell (এপ্রিল ২০০১)। "The United States' Circumcision Century"। Circumcision Statistics of the 20th Century।
- Incidence and prevalence of circumcision in Australia, Circumcision Information Australia, জানুয়ারি ১৯১৩, সংগ্রহের তারিখ ২৪ জানুয়ারি ২০১৫
গ্রন্থপঞ্জী
- Gollaher, David L. (২০০০)। Circumcision: A history of the world's most controversial surgery। New York: Basic Books। আইএসবিএন 0-465-04397-6।
- Paul M. Fleiss, M.D. and Frederick Hodges, D. Phil. What Your Doctor May Not Tell You About Circumcision. New York: Warner Books, 2002: pp. 118–146, paperback (আইএসবিএন ০-৪৪৬-৬৭৮৮০-৫)
- Leonard B. Glick. Marked in Your Flesh: Circumcision from Ancient Judea to Modern America. New York: Oxford University Press, 2005. (আইএসবিএন ০-১৯-৫১৭৬৭৪-X)
- Robert J. L. Darby. A Surgical Temptation: The Demonization of the Foreskin and the Rise of Circumcision in Britain. Chicago: University of Chicago Press, 2005. (আইএসবিএন ০-২২৬-১৩৬৪৫-০)
বাহ্যিক লিঙ্ক
- Jewish Encyclopedia: Circumcision
- VIDEO – Male Circumcision: History, Ethics and Surgical Considerations Dr. Benjamin Mandel speaks at the University of Wisconsin School of Medicine and Public Health, December 2007.
- Peter Charles Remondino. History of Circumcision from the Earliest Times to the Present. Philadelphia and London; F. A. Davis; 1891.
- Doyle, D (২০০৫)। "Ritual Male Circumcision: A Brief History" (PDF)। Journal of the Royal College of Physicians। 35: 279–285।
- Hodges FM. (Fall ২০০১)। "The Ideal Prepuce in Ancient Greece and Rome: Male Genital Aesthetics and Their Relation to Lipodermos, Circumcision, Foreskin Restoration, and the Kynodesme"। Bull. Hist. Med.। 75 (3): 375–405। doi:10.1353/bhm.2001.0119। PMID 11568485।
- John M. Ephron (২০০১)। "In Praise of German Ritual: Modern Medicine and the Defense of Ancient Traditions"। Medicine and the German Jews। New Haven: Yale University Press। পৃষ্ঠা 222–233। আইএসবিএন 0-300-08377-7।
- Dunsmuir WD, Gordon EM (১৯৯৯)। "The history of circumcision"। BJU Int। 83 (Suppl 1): 1–12। doi:10.1046/j.1464-410x.1999.0830s1001.x। PMID 10349408।
- Gollaher DL (১৯৯৪)। "From ritual to science: the medical transformation of circumcision in America"। Journal of Social History। 28 (1): 5–36। doi:10.1353/jsh/28.1.5।