ঠগি

ঠগি (হিন্দি: ठग्गी or ṭhagī; উর্দু: ٹھگ; সংস্কৃত: sthaga) বিশেষ শ্রেণীর দস্যুদল যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত। ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলায় এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা হিন্দুদের দেবী কালীর পূজা করত।[1] তাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে।[2] ১৮৩০ সালে গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক ভারতে প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে ঠগিদের নির্মূল করতে নির্দেশ দেন। হেনরি শ্লীম্যান কয়েক বছরের চেষ্টার ফলে ঠগিদের নির্মূল করতে সমর্থ হন।[1][3] কিছু হিসেব অনুযায়ী ১৭৪০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হত্যা করেছিল।[4] ঠগিরা সাধারণত দলগতভাবে ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করত এবং পথিমধ্যে অন্য তীর্থযাত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে তাদের সাথে মিশে যেত। তারপর তারা হঠাৎ করেই কোন যাত্রাবিরতিতে ভ্রমণকারীদের গলায় হলুদ রং এর কাপড় পেঁচিয়ে হত্যা করত। তাদের সম্পত্তি লুঠ করে মৃতদেহগুলোকে তারা হিন্দু দেবী কালীর নামে উৎসর্গ করত।[1] হত্যার পর মৃতদেহগুলোকে একসাথে হাড় ভেঙ্গে কবর দিয়ে রাখত যাতে পচন প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়।[5]

ঠগি
ঠগিদের একটি দল (১৮৯৪)
প্রতিষ্ঠা১৩৫৬ সালের পূর্বে
নামকরনসংস্কৃত ঠগ (অর্থ- ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক) শব্দ থেকে এসেছে।
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলভারতীয় উপমহাদেশ
সক্রিয়~৪৫০ বছর
বিচরনভারতীয় উপমহাদেশ
জাতিভারতীয়
সন্ত্রাসী কর্মকান্ডখুন, ডাকাতি

ব্যুৎপত্তি

ঠগি শব্দটি সংস্কৃত ঠগ শব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ- ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক।[6] ভারত শাসনের সময় যেসব শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে থাগ তাদের মধ্যে অন্যতম। শব্দটির অর্থ চোর বা ডাকাত। থাগ শব্দটি সংস্কৃত ঠগি শব্দ থেকে এসেছে। ১৮৩৯ সালে ফিলিপ মেডোউস টেলরের উপন্যাস কনফেসনস অফ অ্য থাগ এর মাধ্যমে ঠগিদের কাহিনী জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একই সাথে ‘থাগ’ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় অন্তর্ভূত হয়ে যায়। এই ধরনের হত্যাকান্ডের গল্প দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে জনসাধারণ্যে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিল।

ইতিহাস

১৩৫৬ সালের জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে থেকে জানা যায়,

১২৯০ এর দিকে সুলতানের শাষন আমলে কিছু ঠগ ধরা পরে, কেউ কেউ বলে এ সংখ্যা এক হাজার তাদের নতুন দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা করেন নি বরং তাদেরকে নৌকায় তুরে ভাটির দেশে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন যাতে তারা আর কোনদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।

স্যার এইস.এম এলিয়ট, "ভারতের ইতিহাস" , iii. ১৪১

ঠগিরা সাধারণত বংশপরম্পরায় এই হত্যাকান্ড ঘটাত। একজন ঠগি বালক ১৮ বছর হলে সে হত্যার অনুমতি পেত। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগিদের কথা প্রথম জানতে পারে। সেসময় একটি গণকবরে ৫০টি মৃতদেহ গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ঠগিরা তাদের দেবীকে বাংলায় ভবানী নামে ডাকত। তারা সাধারনত বছরের এক সময় ঘর সংসার করত এবং শরৎকালে দলগত ভাবে যাত্রা করত মানুষ হত্যার জন্য। ঠগিরা দলের সর্দারকে জমাদার নামে অভিহিত করত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ’কালীঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ’ভবানী মন্দির’।

হত্যা পদ্ধতি

ঠগিরা হত্যাকান্ডের জন্য একটি হলুদ রং এর রুমাল ব্যবহার করত যার দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৩০ ইঞ্চি। রুমালটি ভাজ করে তার দুই মাথায় দুটি রুপার মুদ্রা দিয়ে বেধে দিত। হত্যার সময় একজনকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগি ছিল এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যাক্তির গলায় পেঁচিয়ে ধরত ও অরেকজন পা ধরে থাকত।

ঠগিরা হত্যার পর লাশ গুলো মাটিতে পুঁতে ফেলত। কেউ পালিয়ে গেলে ঠগিদের অগ্রবর্তী দল তাদের হত্যা করত। তারা সাধারণত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা করত না।

দমন

উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যান (১৮৩৫)

প্রথমদিকে কোন তীর্থযাত্রী নিখোজ হলে ব্রিটিশ শাষকরা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করত কিন্তু যখন আস্তে আস্তে ব্রিটিশরাও নিখোজ হওয়া শুরু করল তখন গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক জানতে পাড়েন এটাতে একটি ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাত রয়েছে। তখন তিনি ঠগীদের নির্মূল করতে ১৮৩০-এর সালে ভারতের প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে নির্দেশ দেন।

হেনরি ঠগিদের নির্মুল করতে গুপ্তচর নিয়োগ করেন যাতে তাদের গতিবিধি সম্পর্কে আগেই আচ করা যায়। ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩৭০০ ঠগিকে ধরতে সমর্থ হন। ১৯৪০ সালের দিকে প্রায় ৫০০ ঠগির ফাঁসি দেওয়ার পর ঠগিদের সংখ্যা কমে আসে। এখনো ভারতের রাজস্থানে ঠগিদের বংশধরদের দেখা যায় তবে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।

বাহরাম জমাদার

বাহরাম জমাদারের জন্ম ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে। অনুমান করা হয় সে ৯৩১ জন মানুষকে হত্যা করেছিল বা হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। সে ছিল ঠগিদের রাজা। তার কায়দা ছিল গলায় রুমাল পেঁচিয়ে মানুষকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা। ধরা পড়ার পর তাকে মৃত্যু দণ্ড দেয়া হয়। ১৮৪০ এ তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

ঠগিদের তথ্য সংবলিত বই সমূহ

  • Dash, Mike Thug: the true story of India's murderous cult আইএসবিএন ১-৮৬২০৭-৬০৪-৯, 2005
  • Dutta, Krishna (2005) The sacred slaughterers. Book review of Thug: the true story of India's murderous cult by Mike Dash. In The Independent (Published: 8 July 2005) text
  • Guidolin, Monica "Gli strangolatori di Kali. Il culto thag tra immaginario e realtà storica", Aurelia Edizioni, 2012, isbn: 978-88-89763-50-6.
  • Paton, James 'Collections on Thuggee and Dacoitee', British Library Add. Mss. 41300
  • Woerkens, Martine van The Strangled Traveler: Colonial Imaginings and the Thugs of India (2002),

বহিঃসংযোগ

তথ্যসূত্র

  1. "Tracing India's cult of thugs". 3 August 2003. Los Angeles Times.
  2. http://www.britannica.com/EBchecked/topic/594263/thug
  3. http://www.mahavidya.ca/hindu-sects/the-thuggee-cult/
  4. Rubinstein, W. D. (২০০৪)। Genocide: a history। Pearson Education। পৃষ্ঠা 82–83। আইএসবিএন 0-582-50601-8।
  5. R.V. Russell; R.B.H. Lai (১৯৯৫)। The tribes and castes of the central provinces of India। Asian Educational Services। পৃষ্ঠা 559। আইএসবিএন 978-81-206-0833-7।
  6. Thugs 1902 Encyclopædia Britannica'.Pali-sthag
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.