ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ি

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ী বৃটিশ শাসনামলে দিনাজপুর জেলায় যে কজন জমিদার ছিলেন, তার অন্যতম হচ্ছেন ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নাধীন ঘুঘুডাঙ্গায় এই জমিদারদের অবস্থা ছিল। বৃটিশ শাসিত দিনাজপুর ১১টি থানায় এই জমিদারের এষ্টেট ছিল। এষ্টেটে বসবাসরত প্রজাদের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রেখেই ঘুঘুডাঙ্গার জমিদাররা তাদের জমিদারী চালাতেন। ১৮টি কাচারী ও ৪১টি তহশীল অফিস পরিচালিত হতো এই জমিদারদের আওতায়। [1]

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ী
ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ীর প্রবেশ পথ
সাধারণ তথ্য
অবস্থাসংরক্ষিত
অবস্থানঘুঘুডাঙ্গা
ঠিকানাআউলিয়াপুর ইউনিয়ন, কোতয়ালী থানা
শহরদিনাজপুর
দেশবাংলাদেশ
আনুমানিক সম্পূর্ণকরণ(১৭৭১-১৭৮৯)
জমির মালিকফুল মোহাম্মদ চৌধুরী
যে কারণে পরিচিতঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বংশের রাজকীয় বাড়ি

ঘুঘুডাঙ্গার অবস্থান

পূর্নভবা নদীর বামতীরে ঘুঘুডাঙ্গা নামে প্রাচীন গ্রামটির অবস্থান দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ৬মাইল দক্ষিণে কোতয়ালী থানার আউলিয়াপুর ইউনিয়নে। ঘুঘুডাঙ্গা থেকে মাত্র ১২মাইল দক্ষিণে পূর্নভবা নদীর পূর্বতীরে অবস্থান ছিল গুপ্ত পাল শাসনামলে কোটিবর্ষ বিষয়ের শাসন কেন্দ্র কোটিবর্ষ নগরী; যা পরবর্তীতে বানগড় বা দেবকোট নামেও পরিচিত ছিল। ১২০৪-০৫ বাংলা সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী বাংলার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল অধিকারের পর প্রথমে লখনৌতি নামক স্থানে তার রাজধানী স্থাপন করলেও পরবর্তীতে তিনি এই দেবকোটে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। দেবকোট থেকে তিনি ব্যর্থ তিব্বত অভিযানে গিয়ে ফিরে আসেন এবং এ দেবকোটেই তিনি নিহত হন। এ স্থানেই মুসলিম আমলে দমদমা দুর্গও নির্মিত্ত হয়েছিল। তবে এ সবই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এ ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর নিকট এখন রয়েছে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর থানা সদর।

ঘুঘুডাঙ্গার প্রাচীন নাম

বর্তমান ঘুঘুডাঙ্গার প্রাচীন নাম ‘‘একবারপুর’’ প্রায় শতবছর পূর্বে, বৃটিশ শাসনের সময় তৎকালীন ভারতের জলপাইগুড়ির অধিবাসী নবীর মোহাম্মদ ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এই একবারপুরে এসে থেকে যান। একবারপুরের নৈসর্গিক সৌন্ধার্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি এখানে থেকে যেতে পারেন। আবার এমনো হতে পারে যে, একবারপুর জায়গাটি তার ব্যবসায়িক কারণে সুবিধা অনেক মনে হয়েছিল, সে কারণে তিনি সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। কারন যাই হোক, তিনি জলপাইগুড়ি থেকে এখানে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। [1]

ইতিহাস

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বংশের আদি পুরুষ ছিলেন নবীর মোহাম্মদ। তিনি জলপাইগুড়ি থেকে নদীপথে ব্যবসা উপলক্ষে ঘুঘুডাঙ্গার কিছু দূরে পাথর ঘাটায় আসেন এবং বাসাবাড়ী নির্মান করে ৫০০টি ধানভাঙ্গা ঢেঁকি স্থাপন করে নদীপথে কলকাতার চিৎপুরেও ধান চাউলের ব্যবসা কেন্দ্র স্থাপন করেন। তার পুত্র ফুল মোহাম্মদ চৌধুরী ক্রমান্বয়ে বহু জমিদারী ক্রয় করেন এবং পাথর ঘাটা হতে ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার বাড়ী নির্মান করেন। ফুল মোহাম্মদের তিন পুত্র ছিল ওলি মোহাম্মদ চৌধুরী, মোজহর মোহাম্মদ চৌধুরী ও হাজী জমির উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী। হাজী জমির উদ্দিনের ৫ পুত্রের নাম মহিউদ্দীন আহাম্মদ চৌধুরী, সিরাজ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী, এমাজউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, হাজী আমিনউদ্দীন আহমদ চৌধুরী এবং হাজী রহিমউদ্দীন আহমদ চৌধুরী।[1]

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারীর গোড়াপত্তন

ঘুঘুডাঙ্গায় জমিদার বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন নবীর মোহাম্মদের একমাত্র পুত্র ফুল মোহাম্মদ। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হন। নিজেও ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদের প্রসার ঘটান। বর্তমান দিনাজপুর সদর উপজেলার করিমুল্লাপুরে তিনি প্রথম বারের মত নীলামে একটি তউজী কিনে নেন।এই তউজী তখন ৬নং তউজী হিসেবে পরিচিত ছিল। তউজী বলতে এমন একটি এলাকা বুঝত, যেখানে সুনির্দিষ্ট কর ধার্য করা থাকত। এ কর সরকারকে দিতে হতো। ফুল মোহাম্মদের আগে যারা তউজীর দায়িত্বে ছিলেন, বার্ষিক কর ঠিকমত দিতে না পারার কারণে ইংরেজী সরকার তাদের কাছ থেকে এটি নিয়ে নেয়। এরপর এটি নীলামে দেয়া হলে ফুল মোহাম্মদ তা নীলামের মাধ্যমে কিনে নেন।করিমুল্লাপুর তউজী হাতে আসার পর ফুল মোহাম্মদ ছোট খাটো জমিদারে পরিনত হন। জমিদার হিসেবে ইংরেজ সরকার তাকে চৌধুরী উপাধী দেয়। তিনি ধীরে ধীরে জমিদারীতেও উন্নতি করতে থাকেন এবং আরো কয়েকটি তউজী কিনে দিয়ে জমিদারীর সার্বিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রন করতে থাকেন একবারপুর হতে। জমিদারী শুরুর পর তিনি একবারপুরের নাম বদলে দিয়ে ঘুঘুডাঙ্গা রাখেন। তবে জমিদারী সত্বের নাম হয় ‘‘ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেট’’। জমিদাররা পরিচিতি লাভ করেন ‘‘ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার’’ হিসেবে। [1]

জমিদারী এলাকা

একটি ছোট্ট তউজী নীলামে কিনে দিয়ে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারীর সূচনা করেছিলেন ফুল মোহাম্মদ। নিজের নামের সাথে ইংরেজদের দেওয়া চৌধুরী উপাধী যোগ করে নিজের নাম রাখেন ‘‘জমিদার ফুল মোহাম্মদ চৌধুরী’’। পরে তিনি ৩২০নং নারায়নপুর দানিহারী (বর্তমান দিনাজপুর সদর উপজেলার জালালপুর) তউজী সহ আরো ২/৩টি তউজী নীলামে কিনে নিয়ে জমিদারী বড় করেন। ফুল মোহাম্মদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার তিন পুত্র যথাক্রমে ওলি মোহাম্মদ চৌধুরী, মোজহর চৌধুরী এবং হাজী জমিরউদ্দিন চৌধুরী জমিদারী সত্ব লাভ করেন। এদের মধ্যে মোজহর চৌধুরী নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার স্ত্রী তারিফন নেছা চৌধুরানীকে জমিরউদ্দিন চৌধুরী বিয়ে করেন। ফলে মোজহর চৌধুরীর জমিদারী সত্ব পান জমিরউদ্দিন চৌধুরী।এর বাইরেও জমিরউদ্দিন তৎকালীন দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে আরো কয়েকটি তউজী নীলামে নেন। ফলে ঘুঘুডাঙ্গার জমিদারী তার সময়ে বেশ বড় আকার ধারণ করে। জমিরউদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জমিদারী লাভ করেন। তিনি বেশ কিছুদিন জমিদারী করার পর মারা গেলে ২য় পুত্র সিরাজউদ্দিন আহমেদ জমিদারী লাভ করেন। তার মৃত্যুর পর তৃতীয় পুত্র এমাজউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এবং তার মৃত্যুর পর ৪র্থ পুত্র আমিন উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জমিদার হিসেবে দায়িত্ব পরিচালনা করেন।

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী এলাকা ছিল ১১টি থানার মধ্যে। এগুলো হচ্ছে-

  • কোতয়ালী (দিনাজপুর সদর)
  • গঙ্গারামপুর
  • কুশুমুন্ডি
  • রায়গঞ্জ
  • কালিয়াগঞ্জ
  • ইটাহার,
  • পীরগঞ্জ
  • ঠাকুরগাঁও
  • বিরল
  • বোচাগঞ্জ
  • মালদা (রাইও-মুছিয়া)।

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী এলাকায় ছিল ৪১ টি তহশিল অফিস এবং প্রায় ৮০জন বরকন্দাজ, পেয়াদা। দিনাজপুর শহরের বড় ময়দানের পূর্ব পার্শ্বে ঈদগাহ বস্তী মহল্লায় ২টি প্রাচীন কুটিবাড়ী সহ এক বিরাট এলাকা এ জমিদার পরিবারের সম্পত্তি ছিল। [1]

কাচারী ও তহশীলদার

ঘুঘুডাঙ্গার জমিদারের রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের যাবতীয় হিসাব নিকাশের জন্য ২টি কাচারী ছিল

  • ঘুঘুডাঙ্গা কাচারী
  • দেহাবন কাচারী

ঘুঘুডাঙ্গা কাচারীর আওতায় ১৮ জন এবং দেহাবন কাচারীর আওতায় ২১ জন তহশীলদার ছিলেন। সে সময় তহশীলদারকে পাটোয়ারী বলা হতো। অনেক তহশীলদার তাদের নামের সাথে পাটোয়ারী যোগ করতেন। এ রকম কয়েকজন পাটোয়ারী বা তহশীলদার হলেন মোঃ আলাউদ্দিন, শ্রী সতীশ চন্দ্র রায়, হেমচন্দ্র মিত্র,মোঃ বশির পাটোয়ারী,ডাইলা পাটোয়ারী,আব্দুর রহমান পাটোয়ারী,মোঃ তরিকুল ইসলাম।

তহশীলদারদের আওতা

ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের একেকজন তহশীলদারের আওতায় সাধারন্ত ২০ থেকে ৫০টি করে গ্রাম থাকত। এই সব গ্রামের সকলের কাছ থেকে বছরের খাজনা আদায় করা ছিল তার কাজ। খাজনা আদায়ে সহযোগিতার জন্য প্রতি তহশীলদার ১ জন সিপাহী এবং ৩ থেকে ৪ জন কোতয়াল ও ১ জন করে মন্ডল পেতেন। তহশীলদার খাজনা আদায় করতেন, সিপাহী তাকে নিরাপত্তা দিতেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতেন কোতযালরাও। বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদাররা যে ভূমিকা পালন করে থাকেন, তখন কোতয়ালদের ভূমিকা ছিল সে রকমই। মন্ডলের কাজ ছিল প্রজাদেরকে খাজনা পরিশোধের জন্য তাগিদ দেয়া। একজন্য মন্ডল কোন বেতন পেতেন না। বেতন ছিল না কোতয়ালদেরও । তবে খাজনা আদায়ে সহযোগিতা করার কারণে তাদেরকে নিজের খাজনা দিতে হতোনা। অর্থাৎ নিজের খাজনা মওকুফের বিনিময়ে তারা অন্যের খাজনা তুলে দিয়ে জমিদারকে সহযোগিতা করতেন। তহশীলদার ও সিপাহী ছিলেন জমিদারের স্থায়ী কর্মচারী। কিন্তু কোতয়াল ও মন্ডল অস্থায়ী। কোতয়াল ও মন্ডলকে বছরে মাত্র দু বার কাজ করতে হতো। একবার আশ্বিন মাসে। আরেকবার চৈত্র মাসে। ঘুঘুডাঙ্গার জমিদাররা বছরে এ দুবারই খাজনা তুলতেন, কারণ এ সময়ে জমির ফসল উৎপন্ন হয়ে কাটাই মাড়াই এবং বিক্রি হতো। তাই খাজনা আদায়ের উপযুক্ত সময় ছিল আশ্বিন-কার্তিক। কোতয়াল এবং মন্ডলরা বছরের এ দুই মাস কাজ করার বিনিময়ে খাজনা মওকুফ পেয়ে যেতেন, এতেই তারা খুশী ছিলেন। বেতন ছিলনা তহশীলদারদেরও। তারা আদায়ের ওপর ২৫% কমিশন পেতেন। যত আদায়, ততই কমিশন প্রাপ্তির সুযোগ থাকার কারণে তহশীলদাররা বেশি বেশি খাজনা আদায়ে সচেষ্টা থাকতেন। সিপাহীরা সুনির্দিষ্ট বেতন পেতেন, তাদের মাসিক বেতন ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা। জমিদার এষ্টেটের কোষাগার থেকে এই বেতন দেয়া হতো। [1]

জমিদার-ম্যানেজার নায়েব

ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের প্রথম জমিদার ফুল মোহাম্মদ চৌধুরীর সময় তার পুত্র জমিরউদ্দিন চৌধুরী ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফুল মোহাম্মদের মৃত্যুর পর জমিদার হন জমিরউদ্দিন চৌধুরী নিজে। তার সময়ে ম্যানেজার ছিলেন তার প্রথম পুত্র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। পিতা মৃত্যুর পর মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজে জমিদার হন। তিনি তার সম্বন্ধী নালাহারের নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। নাসির উদ্দিন কয়েক বছর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর চাকুরী ছেড়ে দিলে জমিদার মহিউদ্দিন ছোট ভাই সিরাজউদ্দীন চৌধুরীকে ম্যানেজার নিয়োগ করেন। এর পর মহিউদ্দীন চৌধুরী মারা গেলে সিরাজউদ্দিন নিজেই জমিদার হয়ে আসেন। এ সময় তিনি জনৈক জয়নাল আবেদীনকে ম্যানেজার নিযুক্ত করেন।২০ বছর চাকুরী করার পর জয়নাল আবেদীন ম্যানেজারী ছেড়ে দেন। তখন জমিদার সিরাজউদ্দিন তার ছোট ভাই মোঃ আমিনউদ্দিন চৌধুরীকে ম্যানেজার নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে সিরাজউদ্দিন চৌধুরী অসুস্থ্য হয়ে পড়লে আমিনউদ্দিন চৌধুরী জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ম্যানেজার নিয়োগ করেন তার ভাতিজা মঈনউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে আমিনউদ্দিন চৌধুরী জমিদার থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশে জমিদারী ব্যবস্থা বিলুপ্তি ঘটে। ফলে মঈনউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জমিদারী লাভ করতে পারেননি।ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জমিদার নিজে। কিন্তু নিজেই সব কাজ করা যায় না। দরকার হয় ম্যানেজার ও নায়েবের। ম্যানেজার অত্যান্ত মর্যাদাপূর্ণ পদ ছিল। তার মাসিক বেতন ৩০ টাকা। জমিদারের পক্ষে সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা, জমি, খাজনা ইত্যাদি হিসাব রাখা, কাচারী ও তহশীলদারদের পরিচালনা করা, ট্রেজারী মাধ্যম লাটের বছর ভিত্তিক কিস্তি পরিশোধের দায়িত্ব ছিল তার। জমিদারের পর সকল ক্ষমতাই তার। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিতেন, তা জমিদারও মেনে চলতেন। যতদুর জানা যায়, ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেট বা জমিদারী একটি কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হতো। জমিদার ফুল মোহাম্মদ চৌধুরীর বংশধররা এই জমিদারীর মালিক হতেন উত্তরাধিকার সূত্রে। কয়েকজনের সমন্বয়ে কমিটি করে জমিদারী পরিচালনা করা হতো। ম্যানেজার কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতেন, এ কারণে ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটে ম্যানেজার খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তাই বাইরের থেকে ম্যানেজার না নিযে জমিদার পরিবারের সবাই মিলে তাদের নিজেদের বা পরিবারের মধ্য থেকে কাউকে ম্যানেজার করে দিতেন। এজন্য এষ্টেট থেকে ৩০ টাকা মাসিক বেতন দেয়া হতো ম্যানেজারকে। জমিদারীর শুরু থেকে বিলুপ্তি পর্যন্ত ম্যানেজারের বেতন আর কখনো বাড়েনি।ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী ছিলেন নায়েব। প্রজাদেরকে জমি পত্তন, তহশীলদারের আদায় তদারকী ইত্যাদি তার কাজ ছিল। এজন্য তিনি মাসিক ২০ টাকা হারে বেতন পেতেন। নায়েবদের ক্ষমতা ও প্রতাপ ছিল। নায়েব যে সিদ্ধান্ত দিতেন, জমিদার তা বাতিল করতে পারতেন না। ঘুঘুডাঙ্গার অন্যতম জমিদার মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজেও এক সময় দিনাজপুর মহারাজার নায়েব ছিলেন। মহারাজার সদর কাচারী (রাজবাটী),মাছিমপুর কাচারী ও চন্ডিপুর কাচারীর দায়িত্ব ছিল তার ওপর। ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের একজন নায়েবের নাম ছিল মোঃ খতিবুল্লাহ মিয়া। তার বাড়ি ছিল মহব্বতপুর গ্রামে। [1]

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারীর স্থায়ীত্ব

একথা সবারই জানা যে, বাংলাদেশে এক সময় জমিদার তালুকদারদের দ্বারা ভূমি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত ছিল। জমিদার-তালুকদাররা উত্তরাধিকার সূত্রে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভূমি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করতেন। তারা ভূমিতে বসবাসরতদের কাছ থেকে খাজনা নিতেন, খাজনার একটি অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে জমিদারী ধরে রাখতেন। বাকি অংশ নিজেরা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করতেন। কিন্তু ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা দখলের পর এদেশের মানুষের চরম দূরাবস্থা শুরু হয়। এই কোম্পানী বাণিজ্যিক কোম্পানী ছিল, লাভ তাদের মূল্য লক্ষ্য, সে কারণে তারা লাভা লাভের উপর ভিত্তি করে এদেশের ভূমি ব্যবস্থা, রাজস্ব ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আনে। কিন্তু পরিবর্তনের ধারা একেক সময় একেক নীতিতে হওয়ায় মানুষের দূরাবস্থা চরমে ওঠে। জমিদারদের ওপর কখনো কখনো এমন সব নীতি আরোপ করে এবং এমন ভাবে কর ধার্য করে যে, অনেক সময় জমিদার ঐ কর দিতে পারতেন না। ফলে জমিদারী নীলামে উঠেত। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৭১ সনের ২৮ আগস্ট জমিদারী ব্যবস্থায় পঞ্চসনা নীতি চালু করে। এই নীতিতে প্রচলিত বার্ষিক রাজস্ব নীতি বর্জন করে পাঁচ বছর মেয়াদে ইজারাদারদের সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্ত দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। এ সময় অনেক ছোট বড় জমিদারী নীলামে উঠে। অবস্থাপন্ন লোকেরা নীলামে জমিদারী কিনে নিয়ে নতুন জমিদার হোন। ঘুঘুডাঙ্গার প্রথম জমিদার ফুল মোহাম্মদ চৌধুরী যখন জমিদার হয়েছিলেন, সম্ভবত সেটা পঞ্চ সনা নীতি চালুর পরেই। এ প্রসঙ্গে জমিদার পরিবারের প্রবীণ সদস্য আলতাফ চৌধুরী বলেন, কবে থেকে আমাদের জমিদারী শুরু হয়েছিল বলতে পারবনা। তবে পঞ্চসনা, দশসনা চালুর পর থেকেই আমাদের জমিদারী চালু হয়ে বলে জেনেছি।১৭৭১ সালে চালু পঞ্চসনা ব্যবস্থা পরবর্তীতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নীতিতে ১৭৮৯ নালে দশসনা নীতি চালু করে। ফলে এটা পরিষ্কার যে ১৭৮৯ সালে দশসনা নীতি চালু করে। ফলে এটা পরিষ্কার যে ১৭৭১ হতে ১৭৮৯ সালের মধ্যে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারীর সূচনা হয়। দিনাজপুর কোতয়ালী থানার করিমুল্লাপুরে একটি তউজী নিলামে নিয়ে জমিদারী শুরু করেছিলেন ফুল মোহাম্মদ। তিনি জীবিত থাকতেই আরো ২/৩টি তউজী কিনে জমিদারী সম্পসারিত করেন। তার মৃত্যুর পর জমিরউদ্দিন চৌধুরী দীর্ঘকাল জমিদারী করেন এবং এষ্টেট আরো সম্প্রসারিত করেন। এরপর জমিদার হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনিও দীর্ঘদিন জমিদারী করেন এবং এষ্টেট সম্প্রসারিত করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে সিরাজউদ্দিন চৌধুরী, এমাজউদ্দিন চৌধুরী ও আমিনউদ্দিন চৌধুরী জমিদারী করেন। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বে মুহুর্ত পর্যন্ত এই জমিদারী অটুট ছিল। [1]

জমিদারদের নিরাপত্তা পোশাক ও অন্যান্য

ঘুঘুডাঙ্গার জমিদাররা সরল জীবন যাপন করতেন। তারা অতি সাধারণ পোশাক পড়তেন। ধূতি পাঞ্জাবী অথবা ধূতি সার্ট পড়তেন। সাধারন ভাবে চলাফেরা করতেন এবং প্রজাদের সাথে মেলা মেশা করতেন। খাজনা আদায়ের জন্য তারা কখনো প্রজাদের উপর উৎপীড়ন চালাতেন না। তবে যে সকল প্রজা খাজনা দিতে বিলম্ব করত কিংবা অনাগ্রহ দেখাত, তাদেরকে তারা বুঝতেন। বলতেন, তোমরা যদি খাজনা না দাও তাহলে জমিদারী নীলামে উঠবে, নতুন জমিদার যারা আসবে, তারা হয়তো কঠিক নির্যাতন চালাবে তোমাদের উপর। এরকম যেন না হয়, সে জন্য খাজনা দিতেই হবে। এ ভাবেই ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার এবং তাদের নিয়োজিত লোকবল খাজনা আদায় করতেন। তারা সরকারের খাজনা নিয়মিতই বছর বছর দিতেন।জমিদারদের নিরাপত্তার জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা ছিলনা। তবে এষ্টেটের নিরাপত্তার জন্য পাইক, পেয়াদা, বরকন্দাজ, সিপাহী ছিল। ঘুঘুডাঙ্গায় জমিদারীর মূল কাচারী ছিল। এর নিরাপত্তার জন্য ৬ জন পাহাড়াদার ছিল। নেপালী, গুর্খা, পাঠান বংশীয় এই পাহাড়াদারদের গায়ে খাঁকি পোশাক ছাড়াও কোমরের বেল্ডে ‘‘ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেট’’ লেখা মনোগ্রাম থাকত। [1]

ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের খাজনা

সরকারের কাছে ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটকে বছরে প্রায় ১ লাখ টাকা খাজনা দিতে হতো। এস্টেট থেকে প্রজাদের কাছে থেকে প্রতি বিঘায় ২ আনা হতে ৪ আনা পরিমান খাজনা আদয় করা হতো। বছরে ২ বার আশ্বিন ও চৈত্র মাসে ধান কাটার পর এই আদায় চলত। যারা খাজনা দিতেন, তাদের বেশির ভাগ ছিলেন গরীব মানুষ। তবে ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের আওতায় অনেক বড় বড় জোতদারও ছিলেন । বেশ কিছু সাঁওতাল জোতদার ছিলেন, যারা প্রতি বছর এক হাজার টাকা থেকে ১২শত টাকা পর্যন্ত খাজনা দিতেন ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটকে।[1]

বিচার সালিশ

ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটের আওতাধীন এলাকার লোকজনের কোন সমস্যা হলে, বিশেষ করে মামলা মোকদ্দমা করার মত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে জমিদার নিজেই তা সমাধান করে দিতেন। তারা কখনো তাদের প্রজাদেরকে কোর্ট-কাচারীতে আসতে উৎসাহ দিতেন না। সাধারণ মানুষ জমিদারদের সালিশ মেনে নিতেন। [1]

সমাজ কল্যাণমূলক কাজ

ঘুঘুডাঙ্গার জমিদাররা বিভিন্ন সময়ে সামাজিক কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। বর্তমান ঘুঘুডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান ভারতের গঙ্গারামপুরের খোজাপুরেও তারা ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত একটি এম ই স্কুল করেছিলেন। ঘুঘুডাঙ্গায় গরীব মানুষের রোগ মুক্তি কামনায় তারা একটি হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই চিকিৎসালয়টি বর্তমানে সরকারী ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। চৌধুরীদের উদ্যোগে প্রতি চন্দ্র মাসে একবার করে মিলাদ পড়ানো হতো। মিলাদে গরু-খাসি জবাই করে লোকজনকে ভূড়ি ভোজ করানো হতো।বছরে ১২টি মিলাদ ও ভূড়ি ভোজের আয়োজন করতেন জমিদাররা। এছাড়া পল্লী মঙ্গল সমিতি নামে একটি জনকল্যাণ মূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার পরিবারের সদস্যরা। এই সমিতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে অভাবের সময় ধান হাওলাত দিয়ে তাদের দুর্দশা মোচন করা হতো। ঘুঘুডাঙ্গার বর্তমান পোস্ট অফিস তাদের উদ্যোগেই বৃটিশ শাসনামলে স্থাপিত হয়েছিল। ঘুঘুডাঙ্গায় একটি ফুরকানিয়া মাদ্রাসা স্থাপন, মসজিদ নির্মাণ, দিনাজপুর স্টেশন রোড জামে মসজিদের নির্মাণ, বর্তমান দিনাজপুর জেলা জজকোর্ট এলাকায় ২টি মসজিদ নির্মাণ, কাচারীতে কপিকল সহ কূয়া স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার পরিবার। সাধারণ মানুষের পানি সমস্যা মোকাবেলায় জমিদারগণ ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটে পীরপুকুর, বঁচাপুকুর, ঝাড়–য়ানী দিঘী সহ বেশ কয়েকটি বড় দিঘী খনন করেছিলেন। [1]

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারদের সময়কালীন কিছু জমিদার

১৭৭১ সালে ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক পঞ্চসনা নীতি প্রবর্তিত হওয়ার পর যাত্রা শুরু করে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী বা এষ্টেট। পঞ্চসনা নীতির আগে সরকারকে বছর ভিত্তিক খাজনা দেয়ার রীতি চালু ছিল। যদি জমিদাররা বছর ভিত্তিক খাজনা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দিতে ব্যর্থ হতো, তাহলে তার জমিদারী নীলামে চড়ানো হতো। ১৭৭১ সালে এই পদ্ধতি বাতিল করে পঞ্চসনা অর্থাৎ ৫ বছরের ভিত্তিতে জমিদারী ইজারা দেয়ার পদ্ধতি চালু হলে ৫ বছরের জন্য করিমুল্লাপুর তউজী নীলামে ডেকে নিয়ে ফুল মোহাম্মদ জমিদারী চালু করেন।ফুল মোহাম্মদ যখন জমিদার হন সে সময় দিনাজপুর জেলায় সবচেয়ে বড় জমিদার ছিলেন মহারাজা জগদীশনাথ রায়। মহারাজাদের জমিদারী ছাড়াও গনেশতলার রায় সাহেব বেশ বড় জমিদার ছিলেন। দিনাজপুরে যখনই বড় লাট এবং ছোট লাট খাজনা অথবা রাজস্ব সংগ্রহের খবরা খবর নিতে আসতেন, তখন তারা রাজবাটীর মহারাজা, গনেশতলার রায় সাহেব এবং ঘুঘুডাঙ্গার জমিদারকে খবর দিতেন। তারা যেন সার্কিট হাউসে ঢুকতে পারেন, সে জন্য আগেই তাদেরকে গেটপাস দেয়া হতো।সাধারন্ত বাংলা সনের আশিন মাসে বড় লাট এবং চৈত্র মাসে ছোট লাট বৃটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দিনাজপুরে আসতেন। তারা উঠতেন দিনাজপুর সার্কিট হাউজে। এখানে ডিসি/এসপি’র কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতেন। খাজনা ঠিকমত দিলে তারা ডিসি/এসপিকে নির্দেশ দিতেন তারা যেন জমিদারদের কথামত চলে। একারণে স্থানীয় জমিদাররা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সম্মান ও সমীহ পেতেন। লাটেরা জমিদারদেরকে প্যাড, কলম উপহার দিয়ে বলতেন, যদি জমিদাররা কোন হয়রানীর শিকার হয়, তাহলে তারা যেন চিঠি দিয়ে জানায়। সাথে সাথেই একশন নেয়া হবে।মহারাজা, রায় সাহেব ছাড়াও ঘুঘুডাঙ্গার জমিদারদের সময় আরো কয়েকজন জমিদার ছিলেন যাদের বেশ নাম ডাক ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলেন বড়বন্দরের (রেল বাজার) নাহার সিং এষ্টেট, গোবিন্দপুরের মেহরাব আলী চৌধুরী, রাজশাহী ফারসিপাড়ার মফিজউদ্দিন চৌধুরী, বোচাগঞ্জ-দৌলার মহসীন চৌধুরী, ফুলবাড়ীর মোসলেউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। [1]

ঘুঘুডাঙ্গা হাই স্কুলের কথা

সমাজ সেবায় ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার পরিবারের শ্রেষ্ঠ র্কীতি হচ্ছে ঘুঘুডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষায় যখন পশ্চাদপদ একটি এলাকা ঘুঘুডাঙ্গা, তখন এই স্কুলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখানকার জমিদার পরিবারের কয়েকজন উত্তর সুরী। তবে শুরুতেই এটি স্কুল ছিলনা। ছিল সামান্য মক্তব। ২০০৬ সাল থেকে এই স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক বা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার পরিবার ১৯৩০ সালের দিকে ঘুঘুডাঙ্গায় একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। সাধারণ আরবী শিক্ষা হতো এই মক্তবে। পরে আরবী শিক্ষা পাশাপাশি এখানে গণশিক্ষা শুরু হয়। ১৯৩৩ সালের ১ জানুয়ারী এম ই-স্কুল হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারী মঞ্জুরি প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ এই স্কুলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় তখন থেকেই।স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা এমাজউদ্দিন চৌধুরী, সিরাজউদ্দিন চৌধুরী, আলহাজ আমিনউদ্দিন চৌধুরী এবং মঈনউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী। প্রতিষ্ঠাকালে আরো যারা জড়িত ছিলেন তাদের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন আফতাবউদ্দিন চৌধুরী, এমাজউদ্দিন চৌধুরী, জাহের মোঃ সিরাজউদ্দিন চৌধুরী, মুছা মোহাম্মদ কবিরাজ প্রমুখ।

সিরাজউদ্দিন হামিদা ট্রাস্ট ফান্ড

ঘুঘুডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সিরাজউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তার মৃত্যুর পর তার এবং তার স্ত্রী হামিদা চৌধুরানীর নামে একটি ট্রাষ্ট ফান্ড গঠন করেছেন তাদের পুত্র কন্যারা। এর নাম সিরাজউদ্দিন-হামিদা ট্রাষ্ট ফান্ড। এই ফান্ড থেকে প্রতি বছর স্কুলের দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদেরকে বই খাতা কিনে দেয়া হয়।

দেশ বিভাগ ও জমিদারী উচ্ছেদ

১৯৪৭সালে দেশ বিভাগের পর ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারীর বেশীর ভাগ এলাকা ভারতের অর্ন্তভূক্ত হয়। দেশ বিভাগের পর পরই দিনাজপুর জেলা প্রশাসন জরুরী শাসন কার্য পরিচালনার নিমিত্তে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী হতে কিছু টাকা কর্জ হিসাবে গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে অবশ্য এ টাকা পরিশোধ করা হয়। পঞ্চাশের দশকে জমিদারী উচ্ছেদ আইনের ফলে এ পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতার ক্রমাবনতি ঘটে।[1]

মুক্তিযুদ্ধে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারদের অবদান

১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাত্রিতে গণহত্যা শুরুর কয়েকদিন পর দিনাজপুরের বাঙ্গালী, আর্মি, ইপিআর, পুলিশ সহ মুক্তি বাহিনীল প্রায় ১৫০০সদস্য, ২২পি যানবাহন ও প্রচুর অস্ত্রসহ ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে ক্যাম্পে স্থাপন করে। এছাড়া দিনাজপুর শহরের সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বহু কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ পাক আর্মির অত্যাচারের ভয়ে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার পরিবারের সদস্যদের সাহায্য সহযোগিতায় এ বিপুল সংখ্যক মুক্তিবাহিনী, কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের কয়েকদিন যাবত আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। পাক সৈন্যগন ঘুঘুডাঙ্গা অভিমুখে অগ্রসর হলে জমিদার পরিবারের সদস্যসহ সাধারণ মানুসগণ ঘুঘুডাঙ্গা পরিত্যাগ করে ভারতীয় এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। হানাদার পাকা সৈন্যরা মুক্তি ফৌজকে আশ্রয় ও সাহায্য সহযোগিতা দানের কারনে ঐতিহাসিক ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ীতে বোম সেলের আঘাতে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করে। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর জমিদার পরিবারের সদস্যরা দেশে ফেরত আসেন। জমিদার বাড়ী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়ায় তারা ক্রমে দিনাজপুর শহরের ঈদগাহবস্থী মহল্লায় তাদের নিজস্ব জায়গায় বাড়ীঘর নির্মাণ করেন।[1]

দুর্লভ সামগ্রী

১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বেও ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটে দুর্লভ সামগ্রীর মধ্যে ছিল একটি সোনার চেয়ার দেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে, ১০১ ভরি ওজনের সোনার একটি কৃত্তিম কইমাছ,রূপার বাটযুক্ত একটি সুদর্শন ছাতা, রূপার বাট নির্মিত একটি বিরাট হাত পাখা ৪টি রৌপ্য নির্মিত্ত আসা (লাঠি) ইত্যাদি। এ ছাড়া বড় বড় ভোজ সভার রান্নার নিমিত্তে ১৩/১৪টি বিরাট তামার ডেকটি, বিরাট সামিয়ানা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ছিল, যা এককালে দিনাজপুর শহরেরর গন্যমান্য ব্যক্তিগণ বিবাহ বা অন্যান্য ভোজসভার রান্নাবান্নার জন্য ঘুঘুডাঙ্গা থেকে নিয়ে আসতেন। কারন স্বাধীনতার পূর্বে দিনাজপুর শহরে কোন ডেকরেটরের দোকান ছিল না। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাক বাহিনী ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ী ধ্বংসের সময় এ সব দূর্লভ সামগ্রী লুট হয়।[1]

তথ্যসূত্র

  1. "পুরাকীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা / দিনাজপুর জেলা"। দিনাজপুর জেলা প্রশাসন। ২০১৬-০৪-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৫-০৩
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.