করোটি
খুলি (English: Skull) বলতে একটি হাঁড়নির্মিত কাঠামোকে বোঝায়,যা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মাথা গঠন করে।এটি মুখমণ্ডলের কাঠামো বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ক রক্ষাকারী গহবর তৈরি করে।খুলির অংশ দুটি: ক্রেনিয়াম (cranium) এবং ম্য্যান্ডিবল।
মানুুুুষের বেলায় এই দুটি অংশ যথাক্রমে নিউরোক্রেনিয়াম(Neurocranium) ও ভিসেরোক্রেনিয়াম(viscerocranium) বা মুখমণ্ডলীয় অস্থিকাঠামো,যেখানে ম্যান্ডিবল সবচেয়ে বড় হাঁড়।খুলি হল অস্থিকাঠামোর সবচেয়ে সামনের অংশ এবং এটি সেফালাইজেশন ( cephalization) প্রক্রিয়ার ফলাফল-যার কারণে এটি মস্তিষ্কসহ আরো অনেক সংবেদী প্রত্যঙ্গ যেমন চোখ,নাক,কান ও মুখকে ধারণ করে।মানুষের ক্ষেত্রে এই সংবেদী প্রত্যঙ্গগুলো মুখমণ্ডলীয় অস্থিকাঠামোর অংশ।
খুলির কাজসমূহের মধ্যে রয়েছে:মস্তিষ্কের সুরক্ষা,দুইচোখের মধ্যকার দূরত্ব নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক দৃষ্টির সক্ষমতা প্রদান এবং দুই কানের অবস্থান নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে শব্দের অবস্থান নির্ণয় করে শব্দের দিক ও দূরত্ব নির্ণয়ের সক্ষমতা প্রদান করা।শিংযুক্ত চতুষ্পদ (ungulate) সহ আরো অনেক প্রাণীর মাথার খুলি উপরিভাগে শিং এর জন্য উঁচু চূড়ো তৈরির মাধ্যমে প্রতিরক্ষাতেও অংশ নেয়।
ইংরেজি Skull (human) শব্দটি এসেছে Old Norse এর "skulle" থেকে।
খুলি তৈরি হয় কয়েকটি চাপা হাঁঁড়ের সমন্বয়ে এবং এতে রয়েছে বহু ফোরামিনা,ফসা,প্রোসেস আর অনেক কেভিটি ও সাইনাস।প্রাণিবিদ্যার ভাষায় খুলির ছিদ্রগুলোকে ফেনেস্ট্রা বলা হয়।
গঠন
ফেনেস্ট্রা
ফেনেস্ট্রা (ল্যাটিন থেকে আগত,যার অর্থ "জানালা") হল খুলিতে বিদ্যমান ছিদ্রবিশেষ।
- অ্যান্টরবিটাল ফেনেস্ট্রা
- ম্যান্ডিবুলার ফেনেস্ট্রা
- কোয়াড্রেটোজুগুলার ফেনেস্ট্রা
- সাবস্কোয়ামোসাল ফেনেস্ট্রা(স্কোয়ামাস হাঁড়ের দুই অংশের মধ্যবর্তী ছিদ্র,কিছু কিছু রোডেন্ট-জাতীয় প্রাণীতে দেখা যায়)
- টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা:এটি কিছু অ্যামনিয়ট-জাতীয়
প্রাণীর মাথার খুলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য,যেখানে টেম্পোরাল হাঁড়ের দুই পাশে একই আকৃতির দুটো ছিদ্র উপস্থিত।বিবর্তনের অগ্রগতির উপর ভিত্তি করে একটি প্রাণীর পোস্ট অরবিটাল অথবা স্কোয়ামাস হাঁড়ের উপরে/নিচে দুইজোড়া,বা একজোড়া টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা থাকতে পারে,অথবা কোন ফেনেস্ট্রা নাও থাকতে পারে।উপরের দিকের টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রাকে সুপ্রাটেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা, এবং নিচের দিকের টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রাকে ইনফ্রাটেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা বলে।টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রার উপস্থিতি ও গঠনের উপর ভিত্তি করে সিন্যাপ্সিড-জাতীয় প্রাণীদের নামকরণিক শ্রেণীবিন্যাসে প্রাণীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা বেশ জটিল,যেখানে স্তন্যপায়ীরাও অন্তর্ভুক্ত ।
শারীরিবৃত্তীয় পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী একে বিপাকীয় ক্রিয়া বৃদ্ধি এবং চোয়ালের মাংসপেশি বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।প্রথমদিককার অ্যামনিয়ট-জাতীয় প্রাণীদের টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা ছিল না,তবে বিবর্তনের পরবর্তী ধাপে উন্নতদের মাঝে,যেমন সিন্যাপ্সিড-জাতীয় প্রাণী(স্তন্যপায়ী-অনুরূপ সরিসৃপ) এবং ডায়াপসিড-জাতীয় প্রাণীর মাঝে(অধিকাংশ সরিসৃপ ও পরবর্তী পাখি) এটা ছিল।সময়ের সাথে সাথে ডায়াপ্সিড-জাতীয় প্রাণী ও সিন্যাপ্সিড-জাতীয় প্রাণীদের টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা আকারে বড় ও উন্নত হয়েছে চোয়ালকে আরো শক্তিশালী আর মাংসল করার জন্য।ডায়াপ্সিডদের মাঝে ডাইনোসরদের ফেনেস্ট্রা বড় আর উন্নত ছিল,এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম,পাখিদের ক্ষেত্রে এটি আরো বিশেষায়িত রূপ পায়।স্তন্যপায়ী জাতীয় সিন্যাপ্সিডদের একটি মাত্র টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা থাকে,যা অক্ষিগোলকের পেছনভাগে অবস্থিত।
শেণীবিন্যাস
অ্যামনিয়ট-জাতীয় প্রাণীদের মাঝে চার ধরনের খুলি দেখা যায়,যেগুলো টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রার সংখ্যা ও অবস্থান অনুসারে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো:
- অ্যানাপ্সিডা-কোন ছিদ্র নেই
- সিন্যাপ্সিডা-একটি নিচু ছিদ্র(পোস্টঅরবিটাল ও স্কোয়ামাস হাঁড়ের নিচে)
- ইউরিপ্সিডা-একটি উঁচু ছিদ্র(পোস্টঅরবিটাল ও স্কোয়ামাস হাঁড়ের উপরে);ইউপ্সিডরা মুলত ডায়াপ্সিডদের বিবর্তনের ফসল,যেখানে নিচু টেম্পোরাল ফেনেস্ট্রা বিলুপ্ত হয়েছে।
- ডায়াপ্সিডা-দুটি ছিদ্র।
বিবর্তনগতভাবে,তারা নিম্নোক্তভাবে সম্পর্কিত:
- অ্যামনিওটা:
*শ্রেণী:সিন্যাপ্সিডা *বর্গ:থেরাপ্সিডা *গোত্র:ম্যামালিয়া(স্তন্যপায়ী) *(শ্রেণীভুক্ত নয়):সরোপ্সিডা *উপশ্রেণী:অ্যানাপ্সিডা *(শ্রেণীভুক্ত নয়):ইউরেপ্টাইলিয়া *উপশ্রেণী:ডায়াপ্সিডা *(শ্রেণীভুক্ত নয়):ইউরায়াপ্সিডা *শ্রেণী:অ্যাভিস(পাখি)
হাঁড়সমূহ
জুগাল হল খুলির এমন একটি হাঁড়,যা অধিকাংশ সরিসৃপ,উভচর ও পাখিতে পাওয়া যায়।স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে এই হাঁড়টিকে প্রায়শই জাইগোম্যাটিক হাঁড় বা ম্যালার হাঁড় বলা হয়।
প্রিফ্রন্টাল হাঁড় হল এমন একটি হাঁড়,যা অনেক চতুষ্পদ প্রাণীর ল্যাক্রিমাল ও ফ্রন্টাল হাঁড়দ্ব্যকে পৃথক রাখে।
নামকরণ
- কন্ডোক্রেনিয়াম:একটি আদিম তরুণাস্থি-নির্মিত অস্থিকাঠামো
- এন্ডোক্রেনিয়াম
- এপিক্রেনিয়াম
- পেরিক্রেনিয়াম:এক প্রকার পর্দাবিশেষ,যা খুলির বহির্ভাগকে ঢেকে রাখে
মেরুদণ্ডী প্রাণীদের খুলি
মাছ
মাছেদের খুলি কয়েকটি হালকাভাবে যুক্ত হাঁড়ের সমন্বয়ে গঠিত।ল্যামপ্রে ও হাঙরের খুলি শুধুমাত্র তরুণাস্থি নির্মিত,যেখানে উপরের ও নিচের চোয়াল দুটি পৃথক পৃথক অংশ।অস্থিগঠিত মাছের অতিরিক্ত হিসেবে রয়েছে ডার্মাল হাঁড়,যা লাংফিশ ও হলোস্ট মাছের খুলির উপরিভাগ গঠন করে।নিচের চোয়ালটি চিবুক তৈরি করে।
চোয়ালবিহীন মাছের ক্ষেত্রে আরো সরল কাঠামো দেখা যায়,যেখানে খুলির যায়গায় রয়েছে একটি ঝুড়িসদৃশ তরুণাস্থি নির্মিত লম্বাটে কাঠামো,যা মস্তিষ্ককে আংশিকভাবে আবৃত করে এবং যার মাঝে অন্তঃকর্ণ ধারণের জন্য ক্যাপসুল রয়েছে আর রয়েছে একটি একক নাসারন্ধ্র। তরুণাস্থি গঠিত মাছ,যেমন হাঙর,রে-ফিশ -এদের খুলির গঠনও সরল এবং আদিম প্রকৃতির।এদের খুলি একটি একক কাঠামো হিসেবে মস্তিষ্কের নিম্নতল ও দুই পাশকে আবৃত রাখে,তবে এর উপরিভাগ ফ্রন্টানেলি হিসেবে কিছুটা হলেও উন্মুক্ত থাকে।খুলির সামনের অংশে একটি তরুণাস্থি-নির্মিত প্লেট,রোস্ট্রাম ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়-ধারক ক্যাপসুল রয়েছে।এর পেছনে রয়েছে অক্ষিকোটর এবং অন্তঃকর্ণ ধারণের জন্য আরো একজোড়া ক্যাপসুল।সবশেষে,খুলির পেছনের অংশ ক্রমশ সরু হয়ে যায়,সেখানে একটি একক কণ্ডাইল এর উপর খুলির সবচেয়ে বড় ছিদ্র ফোরামেন ম্যাগনাম বসানো থাকে,যা প্রথম কশেরুকার সাথে সংযুক্তি স্থাপন করে।এছাড়াও খুলির বিভিন্ন স্থানে করোটিক স্নায়ূসমূহের জন্য ছোট ছোট ফোরামিনা থাকে।আর চোয়ালজোড়া পৃথক পৃথক তরুণাস্থি নির্মিত,যেগুলোর গঠনপ্রকৃতি খুলির তরুণাস্থি থেকে প্রায় পুরোপুরি আলাদা।
রে-ফিনড মাছের খুলি আদিম প্রকৃতির কাঠামোর বেশ খানিকটা বিশেষায়নের মাধ্যমে নির্মিত।খুলির উপরিভাগ সুগঠিত,এবং যদিও এর হাঁড়সমূহ চতুষ্পদ প্রাণীদের অনুরূপ হাঁড়সমূহের সাথে সম্পর্কিত নয়,তবুও সুবিধার জন্য এগুলোকে একইভাবে নামকরণ করা হয়।খুলির বৃহৎ অক্ষিকোটর-জোড়ার পেছনে ছোট গালসদৃশ অংশ থাকে।উপরের চোয়ালটি মুলত প্রিম্যাক্সিলা থেকে তৈরি হয়,ম্যাক্সিলা টি আরো পেছনে অবস্থান করে এবং সিমপ্লেক্টিক নামের একটি অতিরিক্ত হাঁড় চোয়ালের সাথে খুলির বাকি অংশকে সংযুক্ত করে।
ফসিল লোব-ফিনড মাছের খুলির সাথে যদিও চতুষ্পদ প্রাণীদের খুলির সাদৃশ্য রয়েছে,লাংফিশের ক্ষেত্রে অনুরূপ সাদৃশ্য দেখা যায় না।এদের খুলির উপরিভাগ সুগঠিত নয়,অনেকগুলো বিসদৃশ হাঁড়ের সমন্বয়ে তৈরি,যার সাথে চতুষ্পদ প্রাণীদের খুলির উপরিভাগের কোন সাদৃশ্য নেই।এদের উপরের চোয়াল কেবলমাত্র টেরিগয়েড ও ভোমার নামক হাঁড় দিয়ে তৈরি,যেগুলোর প্রত্যেকটিতে দাঁত থাকে।খুলির অনেকটা অংশই তরুণাস্থি-নির্মিত, এবং কাঠামোটি বেশ সংক্ষিপ্ত।
চতুষ্পদ প্রাণী
প্রথম দিককার চতুষ্পদ প্রাণীদের খুলির সাথে তাদের লোব-ফিনড মাদেদের মধ্যবর্তী পূর্বপুরুষদের খুলির বিশেষ সাদৃশ্য ছিল।খুলির উপরিভাগ গঠিতে হত কয়েকটি প্লেট-সদৃশ হাঁড় দিয়ে,যাদের মাঝে ছিল ম্যাক্সিলা,ফ্রন্টাল, প্যারাইটাল এবং ল্যাক্রিমাল হাঁড়।এটা এন্ডোক্রেনিয়ামকে আবৃত করে রাখতো,যা ছিল হাঙর ও রে-মাছের তরুণাস্থি-নির্মিত খুলির সদৃশ।যেসব পৃথক হাঁড় দ্বারা মানুষের টেম্পোরাল হাঁড়টি গঠিত হয়,সেই একই হাঁড়গুলোর সমন্বয়ে এই খুলির উপরিভাগ তৈরি।মুখগহ্বরের উপরিভাগ চার-জোড়া হাঁড় নির্মিত একটি প্লেট দিয়ে গঠিত,যাতে ভোমার ও প্যালেটাইন হাঁড় রয়েছে।খুলির বেস গঠিত হয় একটি হাঁড়নির্মিত রিং দ্বারা,যেটি ফোরামেন ম্যাগনামকে এবং একটি মধ্যবর্তী হাঁড়কে ঘিরে থাকে;এগুলো আবার স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অক্সিপিটাল হাঁড় ও স্ক্যাফয়েড হাঁড়ের অংশবিশেষের সমগোত্রীয়।সবশেষে,নিচের চোয়ালটি অনেকগুলো পৃথক হাঁড়ের সমন্বয়ে গঠিত,যাদের মধ্যে কেবল সবচেয়ে সামনেরটিই স্তন্যপায়ীদের ম্যান্ডিবল হাঁড়ের সমগোত্রীয়।
টিকে থাকা চতুষ্পদ প্রাণীদের মধ্যে পূর্ববর্তী অনেকগুলো হাঁড় হয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে,অথবা একে অন্যের সাথে সংযুক্ত হয়ে নতুন কাঠামো তৈরি করেছে।
পাখি
পাখিদের খুলি সরীসৃপদের মতই ডায়াপ্সিড জাতীয়,যাতে একটি প্রিল্যাক্রিমাল ফসা আছে।খুলিতে আরো আছে একটি একক অক্সিপিটাল কণ্ডাইল।খুলি মূলত ৫টি হাঁড় দিয়ে গঠিত:ফ্রন্টাল(মাথার উপরিভাগ),প্যারাইটাল(মাথার পেছনভাগ)প্রি-ম্যাক্সিলা ও ন্যাসাল(উপরের ঠোঁট)এবং ম্যান্ডিবল(নিচের ঠোঁট)।একটি সাধারণ পাখির খুলির ওজন সাধারণত পাখির সম্পূর্ণ ওজনের প্রায় ১% হয়ে থাকে।চোখ খুলির অনেকটা অংশ জুড়ে থাকে,যার চারপাশে ছোটছোট হাঁড়নির্মিত একটি শক্ত আই-রিং থাকে।এই একই বৈশিষ্ট্য সরীসৃপদের মাঝেও লক্ষ্য করা যায়।
উভচর প্রাণী
টিকে থাকা উভচর প্রাণীদের খুলির আকার সাধারণত অনেকটাই সংক্ষিপ্ত,যেখানে বেশকিছু হাঁড় অনুপস্থিত অথবা তরুণাস্থি দ্বারা সম্পূর্ণ /আংশিকভাবে প্রতিস্থাপিত।স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিদের ক্ষেত্রে,নির্দিষ্টভাবে,খুলির বিশেষ গঠনগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল বর্ধিষ্ণু মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটতে দেওয়ার জন্য।পাখিদের মাঝে খুলির বিভিন্ন হাঁড়ের সংযুক্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয়,যেখানে হাঁড়গুলোকে আলাদাভাবে চেনা বেশ দুঃসাধ্য।
মানুষের খুলির গঠন
মানুষের খুলি একটি অস্থিনির্মিত কাঠামো,যা মানব-কঙ্কালের মস্তক গঠন করে।এটি মুখের কাঠামো ধরে রাখে এবং মস্তিষ্কের জন্য একটি গহ্বর তৈরি করে।অনাহ্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর খুলির মত এটিও মস্তিষ্ককে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে।
মানুষের খুলির তিনটি পৃথক অংশ আছে,যেগুলোর ভ্রূণগত উৎপত্তিও ভিন্ন ভিন্ন- নিউরোক্রেনিয়াম,সুচার এবং মুখমণ্ডলীয় অস্থিকাঠামো(বা মেমব্রেনাস ভিসেরোক্রেনিয়াম)।নিউরোক্রেনিয়াম (বা মস্তিষ্কের বাক্স),মস্তিষ্ক ও ব্রেইনস্টেম কে আব্বৃত ও সুরক্ষিত করার জন্য সুরক্ষা গহবর তৈরি করে।খুলির উপরিভাগের হাঁড়গুলো একসাথে ক্যালভেরিয়া(বা খুলির টুপি) তৈরি করে।মেমব্রেনাস ভিসেরোক্রেনিয়াম এ ম্যান্ডিবল হাঁড়টিও অন্তর্ভুক্ত।
সুচার হল,নিউরোক্রেনিয়াম এর হাঁড়গুলোর মধ্যকার দৃঢ় সংযোগস্থল।
মুখমণ্ডলীয় অস্থিকাঠামো তৈরি হয় মুখমণ্ডল গঠনকারী হাঁড়সমূহ দ্বারা।
মানুষের খুলির হাঁড়সমূহ
ম্যান্ডিবল ছাড়া,খুলির বাকি সব হাঁড়ই পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে সুচারের মাধ্যমে,যা কিনা সিনআর্থ্রোডায়াল(অনড়) ধরনের জয়েন্ট;যা অসিফিকেশন প্রক্রিয়ার সৃষ্ট এবং যার মাঝে বিদ্যমান "শার্পি'স ফাইবার" একে কিছুটা নমনীয়তা দান করে।কখনো কখনো সুচারের মাঝেও অতিরিক্ত হাঁড়ের টুকরো উপস্থিত থাকতে পারে,যেগুলোকে ওরমিয়ান হাঁড় বা সুচারাল হাঁড় বলা হয়।এই ধরনের হাঁড় সাধারণত ল্যাম্বডয়েড সুচারে পাওয়া যায়।
সাধারণভাবে,মানুষের খুলিতে ২২টি হাঁড় থাকে:৮টি নিউরোক্রেনিয়াম বা মস্তিষ্কের আবরণকারী হাঁড় এবং ১৪টি মুখমণ্ডলীয় হাঁড়।নিউরোক্রেনিয়াম এর ৮টি হাঁড় হল- অক্সিপিটাল হাঁড়,একজোড়া টেম্পোরাল হাঁড়,একজোড়া প্যারাইটাল হাঁড়,স্ফেনয়েড হাঁড়,ইথময়েড হাঁড় ও ফ্রন্টাল হাঁড়। মুখমণ্ডল এর ১৪টি হাঁড় হল- ভোমার,২টি নিম্নস্থ ন্যাসাল কঙ্কা,২টি ন্যাসাল হাঁড়,২টি ম্যাক্সিলা,ম্যান্ডিবল, ২টি প্যালেটাইন, ২টি জাইগোম্যাটিক ও ২টি ল্যাক্রিমাল হাঁড়।কেউ কেউ জোড়া জোড়া হাঁড়গুলোকে একটি হাঁড় হিসেবে বিবেচনা করেন,যেমন অনেকে ম্যাক্সিলাকে একটি একক হিসেবে দেখেন,যার দুটি হাঁড় এর দুটি পৃথক অংশ।আবার কেউ কেউ হাইয়য়েড হাঁড় বা মধ্যকর্ণের তিনটি ক্ষুদ্র হাঁড়কেও এতে অন্তর্ভুক্ত করেন,তবে মানুষের খুলির হাঁড়ের সংখ্যা সচরাচর ২২টিই ধরা হয়।
এই হাঁড়গুলোর মাঝে- নিউরোক্রেনিয়াম এর অক্সিপিটাল,প্যারাইটাল,ফ্রন্টাল এবং মুখমণ্ডল এর ন্যাসাল,ল্যাক্রিমাল ও ভোমার হাঁড়সমূহ চ্যাপ্টাকৃতির হাঁড়।
ক্যাভিটি এ ফোরামেনসমুহ
খুলিতে রয়েছে অনেক সাইনাস,প্যারান্যাসাল সাইনাস নামক বায়ুপূর্ণ গহ্বর এবং অসংখ্য ফোরামিনা।সাইনাসগুলো শ্বাশনালীর আবরণী কোষ দিয়ে আবৃত থাকে।এদের কাজ হল: খুলির ওজন হ্রাস করা,কণ্ঠে অনুরণন সংযোজন এবং নাকের মধ্য দিয়ে আগত বাতাসকে উষ্ণ ও আর্দ্র করা।
ফোরামিনা হল খুলিতে বিদ্যমান ছোট ছোট ছিদ্র।এদের মাঝে সবচেয়ে বড় ছিদ্রটিকে বলে ফোরামেন ম্যাগনাম,যার মধ্য দিয়ে সুষুম্নাকাণ্ড,কিছু স্নায়ু ও অনেক রক্তনালী গমন করে।
প্রোসেস
মানুষের খুলিতে থাকা প্রোসেস বা উদগত অংশগুলো হল: ম্যাস্টয়েড প্রোসেস এবং জাইগোম্যাটিক প্রোসেস সমূহ।
মানুষের খুলির ভ্রূণগত উৎপত্তি
খুলি একটি জটিল কাঠামো,এর হাঁড়সমূহ অন্তঃমেমব্রেন এবং অন্তঃকণ্ড্রিয়াল-উভয় প্রকার অসিফিকেশন দ্বারা সৃষ্ট।খুলির উপরিভাগের হাঁড়গুলো,মুখমণ্ডলীয় হাঁড়সমূহ ও ণিউরোক্রেনিয়াম এর দুইপাশের হাঁড়গুলো ডার্মাল হাঁড়;যা অন্তঃমেমব্রেন অসিফিকেশন এর মাধ্যমে সৃষ্ট।যদিও টেম্পোরাল হাঁড় অন্তঃমেমব্রেন অসিফিকেশন এর মাধ্যমে সৃষ্ট;এন্ডোক্রেনিয়াম, মস্তিষ্ক ধারণকারী হাঁড়সমূহ(অক্সিপিটাল,স্ফেনয়েড ও ইথময়েড) মূলত অন্তঃকন্ড্রিয়াল অসিফিকেশন এর মাধ্যমে সৃষ্ট। আবার ফ্রন্টাল ওও প্যারাইটাল হাঁড়দ্বয় সম্পূর্ণভাবে অন্তঃমেমব্রেনাস।খুলির বেস এবং ফোসাসমূহ;সম্মুখ,মধ্যবর্তী ও পশ্চাৎ ক্রেনিয়াল ফোসা-এদের জ্যামিতিক অনুপাত খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়।সম্মুখ ক্রেনিয়াল ফোসাটি মূলত গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে পরিবর্তিত হয়,আর খুলির জন্মগত ত্রুটিগুলো মূলত এই সময়েই ঘটে।
জন্মের সময়,মানুষের খুলি ৪৪টি পৃথক হাঁড়ের অংশের সমন্বয়ে গঠিত হয়।বৃদ্ধি চলাকালে এই হাঁড়ের অংশগুলোর মাঝে অনেকগুলোই একত্রে সংযুক্ত হয়ে শক্ত হাঁড় তৈরি করে(যেমন ফ্রন্টাল হাঁড়)।খুলির উপরিভাগের হাঁড়গুলো প্রথমদিকে ফ্রন্টানেলি নামের ঘন যোজককলা-পূর্ণ অঞ্চল দ্বারা পৃথক করা থাকে।মোট ৬টি ফ্রন্টানেলি দেখা যায়: ১টি সম্মুখ(ফ্রন্টাল),১টি পশ্চাৎ(অক্সিপিটাল),২টি স্ফেনয়েড(সম্মুখপার্শ্বীয়) ও ২টি ম্যাস্টয়েড(পশ্চাৎপার্শ্বীয়)।জন্মের সময় এই ফ্রন্টানেলি গুলো তন্তুময় ও নড়নক্ষম থাকে,যা জন্মপ্রক্রিয়া ও পরবর্তী মস্তিষ্ক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়।এই প্রক্রিয়া "অবস্টেট্রিকাল হিঞ্জ" এর উপর বেশ চাপ প্রয়োগ করে,যা স্কোয়ামাস হাঁড় ও অক্সিপিটাল হাঁড়ের সংযোগস্থলে অবস্থিত।এই চাপের ফলে সম্ভাব্য জটিলতা হল গ্রেট সেরেব্রাল শিরা ফেটে যাওয়া।বৃদ্ধি ও অসিফিকেশন এর অগ্রগতির সাথে সাথে ফ্রন্টানেলির যোজককলা অংশ ধীরে ধীরে অস্থি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে সুচার সৃষ্টি করে।মানুষের খুলিতে মোট ৫টি সুচার রয়েছে: ২টি স্কোয়ামাস সুচার,১টি করোনাল,১টি ল্যাম্বডয়েড ও ১টি স্যাজাইটাল সুচার। পশ্চাৎ ফ্রন্টানেলি সাধারণত জন্মের আট সপ্তাহের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়,কিন্তু সম্মুখ ফ্রন্টানেলি জন্মের আঠারো মাস পর্যন্তও খোলা থাকতে পারে।সম্মুখ ফ্রন্টানেলিটি ফ্রন্টাল ও প্যারাইটাল হাঁড়দ্বয়ের সংযোগস্থলে অবস্থিত,এটি একটি শিশুর কপালের উপরদিককার কোমল অংশ।মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে এই অঞ্চলের স্পন্দন পর্যবেক্ষণ এর মাধ্যমে একটি শিশুর হৃদস্পন্দন গোনা সম্ভব।
নবজাতকের মাথার খুলি সাধারণত শরীরের অন্যন্য অংশের অনুপাতে বড় হয়।আর মুখমণ্ডলীয় অস্থিকাঠামোটি ক্যালভেরিয়ার এক সপ্তমাংশ হয়(যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে অর্ধেক)।খুলির বেস খাটো ও সরু হয়,যদিও অন্তঃকর্ণ প্রায় প্রাপ্তবয়স্কদের সমান আকৃতির হয়।
মানুষের খুলির প্রায়োগিক গুরুত্ব
ক্রেনিওসাইনোস্টোসিস হল এমন একটি অবস্থা,যেখানে একটি শিশুর এক বা একাধিক তন্তুময় সুচারের সংযুক্তি ঘটে,যার ফলে খুলির বৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসে।খুলিটি তখন সুচারের অনুলম্বভাবে বাড়তে পারে না,ফলে এটি আনুভূমিকভাবে বাড়তে থাকে।কখনো কখনো এই সমস্যাযুক্ত খুলিটি বর্ধিষ্ণু মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান করে দিতে পারে,কিন্তু সেক্ষেত্রেও একটি অস্বাভাবিক আকৃতির মাথা ও অস্বাভাবিক মুখমণ্ডল তৈরি হয়।আবার যেসব ক্ষেত্রে খুলিটি বর্ধিষ্ণু মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান করে দিতে পারে না,সেসব ক্ষেত্রে ক্রেনিওসাইনোস্টোসিস এর ফলে অন্তঃমস্তিষ্ক চাপ বাড়তে থাকে,যার ফলে দৃষ্টিশক্তি ব্যহত হওয়া,ঘুমের অপ্রতুলতা,খাদ্যগ্রহণের অসুবিধা এমনকি মানসিক প্রতিবন্ধিতাও দেখা দিতে পারে।
কপার বিটেন স্কাল হল এমন একটি অবস্থা,যেখানে অতিরিক্ত অন্তঃমস্তিষ্ক চাপ খুলির অভ্যন্তরভাগককে বিকৃত করে দেয়।এই ধরনের নামকরণের কারণ হল,খুলির অভ্যন্তরভাগে কামারদের ব্যবহৃত বল-পিন হাতুড়ির আঘাতের অনুরূপ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।শিশুদের মাঝে এটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
আঘাত ও চিকিৎসা
মস্তিষ্কের আঘাত মৃত্যুর ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে।সাধারণত খুলি তার মজবুত কাঠামোর মাধ্যমে মস্তিষ্ককে আঘাত থেকে রক্ষা করে;খুলি হল প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সবচেয়ে মজবুত কাঠামোগুলোর একটি,যার এক সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধ কমাতে এর উপর এক টন ওজন প্রয়োগ করতে হবে।তবে,অনেক সময়,মাথার আঘাত থেকে সাবডুরাল হেমাটোমা-র মত প্রক্রিয়ার কারণে অন্তঃমস্তিষ্ক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।এসব ক্ষেত্রে,অতিরিক্ত অন্তঃমস্তিষ্ক চাপের প্রভাবে ফোরামেন ম্যাগনাম দিয়ে মস্তিষ্ক নিচে নেমে যেতে পারে,কারব মস্তিষ্কের প্রসারিত হওয়ার আর কোন জায়গা নেই;যার ফলে উপর্যুপরি মস্তিষ্কের আঘাত,এমনকি মৃত্যুও হতে পারে,যদি না দ্রুত অস্ত্রোপচার এর মাধ্যমে অন্তঃমস্তিষ্ক চাপ কমানো হয়।এই কারবেই,মাথায় আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
নিওলিথিক সময়ে ফিরে গেলে দেখা যায়,সে সময় ট্রেপ্যানিং নামের এক প্রকার অস্ত্রোপচার করা হত।সেখানে খুলিতে একটি ছিদ্র করা হত।ঐ সময়কার খুলিসমূহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে,এই ধরনের রোগীরা অনেকসময় এই ধরবের অস্ত্রোপচার এর পরে অনেক বছর বেঁচে থাকত।আবার এও হতে পারে, যে এই ট্রেপ্যানিং প্রক্রিয়াটি কেবল ধর্মীয় আচার হিসেবে পালন করা হতো।এই প্রক্রিয়াটি এখনো টিকে আছে,তবে একে সাধারণভাবে ক্রেনিওটোমি বলা হয়।
২০১৩ সালের মার্চে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মত,গবেষকরা মাথার খুলির একটি বড় অংশকে প্রিসিশন-অর্থাৎ একটি ত্রিমাত্রিক-প্রিন্টেড পলিমার ইমপ্ল্যান্ট দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হন।এরও ৯ মাস পর,একজন ডাচ-মহিলার মাথার খুলিকে ত্রিমাত্রিক-প্রিন্টেড প্লাস্টিক পলিমার দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত করা হয়।ঐ ভদ্রমহিলা হাইপারঅস্টোসিসে ভুগছিলেন,যার কারণে তার খুলির পুরুত্ব বেড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের উপর চাপ প্রয়োগ করছিল।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH) এর অর্থায়নে বোস্টনের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষকদের দ্বারা ২০১৮সালে পরিচালিত এক স্টাডিতে দেখা যায়,মস্তিষ্কের কোন অংশে আঘাতের কারণে প্রদাহ ঘটলে অস্থিমজ্জা ও প্রতিরক্ষাকাড়ী কোষসমূহ রক্তনালীর মধ্য দিয়ে না গিয়ে বরং মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চ্যানেলের মাধ্যমে ঐ স্থানে পৌছায়।
লিঙ্গান্তর প্রক্রিয়া
অস্ত্রোপচার এর মাধ্যমে লিঙ্গঃত দ্বৈততা বহনকারী খুলির পরিবর্তন সাধন,মুখমণ্ডলে নারীভাব আনার অস্ত্রোপচারের অংশ হিসেবে করা হয়ে থাকে,যা কয়েকটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতির সমন্ব্য;যার মাধ্যমে পুরুষালী চেহারার গঠনকে নারীজাতীয় আদর্শ মুখমণ্ডলের আকৃতি প্রদানের চেষ্টা করা হয়।লিঙ্গান্তরিত মানুষদের জন্য এই প্রক্রিয়াটি চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মানুষের খুলির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক
কৃত্রিমভাবে খুলির বিকৃতি সাধন কিছু কিছু আদি সংস্কৃতিতে বেশ বড় একটি ঐতিহাসিক চর্চা।শিশুদের খুলির আকৃতি পরিবর্তনের জন্য তার ও কাঠের বোর্ড ব্যবহার করে খুলির উপর চাপ প্র্যোগ করা হতো।জন্মের পরপরই এই প্রক্রিয়া শুরু হতো এবং বেশ কয়েক বছর ধরে চলত।
অস্থিবিদ্যা
মুখমণ্ডল এর মতো, খুলি এবং দাঁতও একজন মানুষের পূর্ব ইতিহাস ও উৎপত্তি নির্দেশ করতে পারে।