আর্য
আর্য হচ্ছে একটি প্রাচীন জাতিবিশেষ।
সংজ্ঞা
সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন শ্লোক অনুসারে “সর্বে গত্যর্থাঃ জ্ঞানার্থাঃ প্রাপ্ত্যর্থাশ্চ” - সমূদায় গমনার্থক ধাতু জ্ঞানার্থক ও প্রাপ্ত্যর্থক। সুতরাং, যারা জ্ঞানশীল অথবা যারা (শাস্ত্রসীমায়) গমন করেন কিংবা যারা (শাস্ত্রের পার) প্রাপ্ত হন, তারাই আর্য। যাস্কাচার্যের মতে ‘আর্য’ শব্দের নিরুক্তগত অর্থ ‘ঈশ্বরপুত্র’। অর্থাৎ ঈশ্বরের যথার্থ পুত্রকে ‘আর্য’ নামে সম্বোধন করা হয়। পিতার অনেক পুত্র থাকা সত্ত্বেও পিতার অনুবর্তী, আজ্ঞা পালনকারী, সদাচারী, আদর্শ পুত্রকেই প্রকৃতপক্ষে পুত্র বলা হয়ে থাকে। সেইরূপ, যদ্যপি মানবমাত্রেই ঈশ্বরের পুত্র তথাপি সদাচারপরায়ণ পুরুষকেই ঈশ্বরপুত্র অর্থাৎ ‘আর্য’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আর্যরা ভারতবর্ষে বিদেশি অনুপ্রবেশ কারী এটি এংরেজ আমলে প্রচারিত একটি ধারনা। যা সর্বৈব মিথ্যা।
বিশ্লেষকদের অভিমত
ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা বলেন, আর্যগণ প্রথমে পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা দলবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো পশু সাথে নিয়ে ঘাস আচ্ছাদিত অঞ্চল বা প্রদেশে গমন করতেন। পরে সে স্থানের ঘাস পশু খাদ্য হিসেবে নিঃশেষিত হলে তারা পুনরায় অন্য অঞ্চল বা প্রদেশে যেতেন। এভাবে তারা প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতেন বলে আর্য (অর্থাৎ গমনশীল) নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আর্যগণ নিরন্তর এরূপ স্থান পরিবর্তন খুবই কষ্টদায়ক বিবেচনায় এনে এক স্থানে অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা চালায়। উপায় হিসেবে কৃষিকাজকেই তারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিযুক্ত হয়। এজন্যই তারা আর্য (অর্থাৎ কৃষিজীবি) নামে প্রসিদ্ধ হন। শেষোক্ত পক্ষের মতবাদে আর্য শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃষিকর্মকারী, কারণ ও ধাতুর কর্ষণার্থও আছে।
উপমহাদেশীয় শাস্ত্র অনুসারে
প্রাচীন গ্রন্থসমূহে ‘আর্য’ শব্দের অর্থঃ কিরূপ তা দেখুন-
#বেদঃ
• “আর্যা ব্রতা বিসৃজন্তো অধি ক্ষমি।” (ঋগ্বেদ ১০/৬৫/১১)
• “কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্।’’ (ঋগ্বেদ ৯/৬৩/৫)
• “বি জানীহ্যার্যান্যে চ দস্যবো বর্হিষ্মতে রন্ধয়া শাসদব্রতান্।” (ঋগ্বেদ ১/৫১/৮)
উক্ত মন্ত্রসমূহে সত্য, অহিংসা, পবিত্রতাদি উত্তম ব্রতধারী ব্যক্তিদের ‘আর্য’ বলা হয়েছে এবং বিশ্বের নর-নারী সকলকে এইরূপ ‘আর্য’ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
• “আর্যবৃত্ত।’’ (গৌতম ধর্মসূত্র ১৯/৯৬)
এখানে সদাচারপরায়ণ অর্থে ‘আর্য’ শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে।
.
#বাল্মীকি_রামায়ণঃ
• “সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। আর্যসর্বসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।।” (বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬)
অর্থাৎ, রামচন্দ্র সদাসর্বদা সৎপুরুষদের সাহচর্যে থাকতেন যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সাথে মিলে থাকে তথা তিনি আর্য, সমদর্শী ও সকলের প্রিয় ছিলেন।
.
#বিদুর_নীতিঃ
• “আর্য কর্মাণি রজ্যন্ত ভূতি কর্মাণি কুর্বতে হিতং চ নাভ্যসূযন্তি পণ্ডিতা ভরতর্ষভ।
ন স্বে সুখে বৈ কুরুতে প্রহর্ষ। নান্যস্য দুঃখে ভবতি প্রহৃষ্টঃ।।
দত্ত্বা ন পশ্চাৎ কুরুতেহনুতাপং স কথ্যতে সৎপুরুষার্য শীলঃ।।” (বিদুর নীতি ১/৩০/১/১৮)
এই বচনসমূহে অত্যন্ত ধার্মিককে ‘আর্য’ বলা হয়েছে।
.
#চাণক্যনীতিঃ
• “অভ্যাসাদ্ ধার্যতে বিদ্যা কুলং শীলেন ধার্যতে। গুণেন জ্ঞাযতে আর্যঃ কোপো নেত্রেণ গম্যাতে।।” (চাণক্য নীতি ৫/৮)
এখানে গুণীজনকে ‘আর্য’ বলা হয়েছে।
মহাভারতঃ
• “স বাল এবার্যমতির্নৃপোত্তমঃ।” (মহাভারত আদিপর্ব ৪০/৭)
এই বচনে উত্তম রাজকুমারের সাথে ‘আর্যমতি’ বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে যার অর্থ শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান।
.
#কৌটিল্য_অর্থশাস্ত্রঃ
• “ব্যবস্থিতার্যমর্যাদাঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতঃ।”
আর্যগণের মর্যাদাকে যে ব্যবস্থিত করতে সমর্থ সেই রাজ্যাধিকারী, এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
.
#শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাঃ
• “কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্। অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরম
র্জুন।।” (ভগবদ্গীতা ২/২)
এখানে যুদ্ধসাজে সজ্জিত ভীরুতাপ্রাপ্ত অর্জুনের বৃত্তিকে ‘অনার্যবৃত্তি’ বলা হয়েছে। এস্থলে আর্যকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।
.
#ধর্ম্মপদঃ
• “অরিযপ্পবেদিতে ধর্ম্মে সদা রমতি পণ্ডিতো।”
অর্থাৎ, পণ্ডিতগণ আর্যপ্রদর্শিত ধর্মে বিচরণ করেন।
• “ন তেন অরিযো হোতি যেন পাণতি হিংসতি। অহিংসা সব্ব পাণানং অরিযোতি পবচ্চতি।।” (ধর্ম্মপদ ২৭০/১৫)
অর্থাৎ, প্রাণীহিংসা করে কোনও ব্যক্তি আর্য হয় না। যে ব্যক্তি হিংসা করে না সে-ই আর্য।
.
#শব্দকল্পদ্রুমঃ
• “মান্যঃ উদারচরিতঃ শান্তচিত্তঃ ন্যায়পথাবলম্বী প্রকৃতাচারশীলঃ সততকর্তব্যকর্মানুষ্ঠাতা।
যদুক্তং কর্তব্যমাচরন্ কার্যম্ অকর্তব্যমনাচরন্। তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে সতু আর্য ইতি স্মৃতঃ।।” (শব্দকল্পদ্রুম ১০/৫৭)
অর্থাৎ, মান্য(সম্মানযোগ্য), উদারচরিত্র, শান্তচিত্ত, ন্যায়ের পথ অবলম্বনকারী, শাস্ত্রানুকুল আচরণকারী, নিরন্তর কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠানকারী এবং অসৎকর্ম বর্জনকারী পুরুষকেই স্মৃতি অনুসারে ‘আর্য’ বলা হয়।