আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ

গ্যালিলিও তার নিজের তৈরি টেলিস্কোপে প্রথম আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেন ১৬০৯ সালে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান, গুরুত্বপূর্ণ সব গবেষণালব্ধ তত্ত্ব আর অসামান্য অবদানের কারণে গ্যালিলিও-কে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বলা হয়ে থাকে। এ জন্য তার আবিষ্কার ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিশেষ করে টেলিস্কোপ দিয়ে প্রথম আকাশ পর্যবেক্ষণের ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতিসংঘ ২০০৯ সনকে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ-২০০৯ হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বব্যাপী সারা বছর জুড়ে বিজ্ঞান বিষয়ক নানা কর্মসূচী ও উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালিত এই জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ উদ্‌যাপন কার্যক্রম পরিচালনা করছে মূলত জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক বিভাগ ‘ইউনেস্কো’ এবং আন্তজার্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা ‘আএইউ’। এ জন্য অবশ্য আগেই জাতিসংঘ একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিল যা ২০০৩ সনের জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থার বার্ষিক সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল।[1]

IYA2009 logo

ইতিহাস

১৬০৯ সালে গ্যালিলিও স্বাধীনভাবে এবং উন্নত ধরনের দূরবীক্ষণ যন্ত্র নির্মাণ ও এই যন্ত্রকে জ্যোতির্বিদ্যায় সার্থকভাবে প্রয়োগের করেন। এর আগে ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দে ওলন্দাজ চশমা নির্মাতা লিপেরশাইম তার নির্মিত এক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের কথা প্রকাশ করেন এবং সেই বছরেই এই অদ্ভুত কাচ নির্মিত যন্ত্রের কথা গ্যালিলিওর নিকট পৌঁছে। এসময় তিনি তার এক রচনায় লিখেন: “প্রায় ১০ মাস পূর্বে আমার কাছে সংবাদ পৌঁছে যে জনৈক ওলন্দাজ চশমা নির্মাতা এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যার দ্বারা দূরবর্তী বস্তুদের নিকটবর্তী বস্তুর মতো স্পষ্ট দেখা যায়। এ খবর পাওয়া মাত্র আমি নিজে কিভাবে এরূপ একটি যন্ত্র নির্মাণ করতে পারি তা চিন্তা করতে লাগলাম।” শীঘ্রই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নানা উন্নতি সাধন করে গ্যালিলিও দূরবর্তী বস্তুদের অন্তত ৩০ গুণ বড় করে দেখার ব্যবস্থা করেন।

দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে জ্যোতিষ্কদের প্রথম পর্যবেক্ষণের ফল ‘সাইডরিয়াস নানসিয়াস’ বা ‘নক্ষত্র থেকে সংবাদবাহক’ গ্রন্থে লিপিবব্ধ হয় (প্রকাশকাল ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দ)। চাঁদের পৃষ্ঠের খাদ, ছোট-বড় অনেক দাগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই গ্রন্থে আলোচিত হয়। ভূপৃষ্ঠের ন্যায় চাঁদের উপরিভাগে যে পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, নদী, গহ্বর, জলাশয় প্রভৃতির দ্বারা গঠিত গ্যালিলিও এইরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। দূরবীক্ষণ যন্ত্রে বড় বড় কাল দাগ দেখে তিনি তাদের সমুদ্র মনে করেছিলেন, পরে অবশ্য এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ ২০০৯-এর মূল লক্ষ্য

  • ১) জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা।
  • ২) আকাশ পর্যবেক্ষণ ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী করে তোলা।
  • ৩) উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহে জ্যোতির্বিজ্ঞান কার্যক্রমকে আরও সক্রিয় করে তোলা।
  • ৪) আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষাকে সহায়তা ও উন্নত করে তোলা।
  • ৫) একটি আধুনিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের ভাবমূর্তি নিশ্চিত করে তোলা।
  • ৬) বিজ্ঞান কর্মকান্ডে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
  • ৭) বিশ্বের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণ করা।[2]

১১টি বিশেষ প্রকল্প

ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ-২০০৯ উদ্‌যাপনের জন্য ১১টি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের ১০০ ঘন্টা

২-৫ এপ্রিলে, সারা বিশ্বে ১০০ ঘণ্টা ব্যাপি আকাশ পর্যবেক্ষণ , জ্যোতির্বিজ্ঞান সর্ম্পকে বিভিন্ন্‌ আলোচনা সভা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, যাতে সাধারণ মানুষ জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

গ্যালিলিওস্কোপ

গ্যালিলিওর ব্যবহৃত টেলিস্কোপের মত ছোট টেলিস্কোপ নির্মাণ করে আকাশ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা । এর মূল্য থাকবে অনেক কম এবং সাধারণ মানুষ তা কিনে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে।

কসমিকডাইরী

এটি ইন্টারনেট লগ ভিত্তিক একটি প্রকল্প। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানী এমনকি সাধারণ মানুষও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ও গবেষণার বিষয়বস্তু' নিয়ে মত বিনিময় করতে পারবেন।

মহাবিশ্বের প্রবেশ দ্বার

এটি একটি বিশেষ ধরনের ওয়েবসাইট যার মধ্যে টেলিস্কোপ বা উপগ্রহের মাধ্যমে ধারণকৃত মহাবিশ্বের ছবি ও ভিডিও প্রচার করা হবে যাতে বিশ্বব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী মানুষ সেগুলো দেখতে পারেন এবং ব্লগ করে মতামত জানাতে পারেন।

মহিলা জ্যোতির্বিদ

নারীদের মহাকাশ গবেষণায় অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে এই প্রকল্পের সৃষ্টি। বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানে গবেষণায় পুরুষদের সংখ্যা নারীদের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। এই বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে নারীরা যাতে আরও বেশি সুযোগ পায় সেই ব্যবস্থা করা হবে।

অন্ধকার আকাশ সচেতনতা

এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল এই বছর কোন কোন সময় বিশ্বের কোন কোন শহর বা এলাকা বিদ্যুতবিহীন করা হবে, যাতে মানুষ অন্ধকারে রাতের পরিবেশে ভালোভাবে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে।

গ্যালিলিও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম

বিশ্বব্যাপী ছাত্রছাত্রীদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষা প্রদানের জন্য শিক্ষকদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে যাতে ঐ সব শিক্ষকগণ বই, চার্ট, ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করতে পারেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্ব ঐতিহ্য

জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বে যে সব প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী স'াপনাগুলো আছে সেগুলোকে খুঁজে বের করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

মহাবিশ্ব সচেতনতা

সারাবিশ্বে শারীরিক প্রতিবন্ধিদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন ও উৎসাহিত করার জন্য এই প্রকল্পের সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞান সংগঠনগুলো মহাবিশ্বের ছবি ও ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিদের উৎসাহিত করবে।

পৃথিবী হতে মহাবিশ্বে

মহাকাশে স্থাপিত টেলিস্কোপ ও পৃথিবীর বড় বড় অ্যাবজারভেটরী প্রাপ্ত থেকে মহাবিশ্বের উজ্জ্বলতম তারাপুঞ্জ, নীহারিকা, সুপারনোভা, ইত্যাদির বিরাটাকার আলোকচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন করাই এই কর্মসূচীর লক্ষ্য।

বিশ্বব্যাপী জ্যোতির্বিজ্ঞান উন্নয়ন

অণুন্নত দেশগুলোতে যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কোন সুযোগ নেই সে সব এলাকার জনগণের মাঝে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিই এই কর্মসূচির লক্ষ্য।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই বর্ষ পালিত হচ্ছে।

স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ

আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ পালনের সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিজ্ঞান সংগঠন অণুসন্ধিৎসু চক্রের প্রস্তাবনা ও ডিজাইনে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০০৯ সালের জুলাই মাসে দুটি স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করে। দুটি স্মারক ডাকটিকিটের একটিতে গ্যালিলিও গ্যালিলির সেই বিখ্যাত দুরবিনের প্রতিকৃতি এবং অন্যটিতে আমাদের নিকটতম গ্যালাক্সি এন্ড্রোমিডা নীহারিকার ছবি রয়েছে। উদ্বোধনী খামে রয়েছে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির ছবি। ১৯৭৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপারনিকাসের ৫০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিটটি বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত ডাকটিকিট। [3].[4]

তথ্যসূত্র

  1. আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান র্বষ
  2. "ইউনেস্কো ওয়েব পৃষ্ঠা"। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১৮
  3. MediaBD webpage
  4. "জ্যোতির্বিদ্যার ওপর বাংলাদেশের নতুন ডাকটিকিট"। ১৫ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ অক্টোবর ২০০৯

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.