আতাউর রহমান খান খাদিম
আতাউর রহমান খান খাদিম (১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩ - ২৬শে মার্চ, ১৯৭১) ছিলেন বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ। তিনি ত্রিপুরার খড়গপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। খান খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পদার্থ বিজ্ঞানে ১৯৫৩ সালে বি.এসসি (অনার্স) এবং ১৯৫৪ সালে এম.এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন এবং পশ্চিম জার্মানীর গোটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোয়ান্টাম থিওরী বিষয়ে পি.এইচ.ডি. করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভগে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার সূত্র ধরে ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে এবং হত্যা করে শহীদুল্লাহ্ হলের তৎকালীন মেধাবী এই আবাসিক শিক্ষককে। উল্লেখ্য, খান খাদিম ছাড়া শহীদুল্লাহ্ হলের আরও একজন আবাসিক শিক্ষক সেদিন পাক-বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন। তিনি গণিত বিভাগের শরাফত আলী।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
আতাউর রহমান খান খাদিমের পিতার নাম দৌলত আহমদ খাদিম এবং মাতার নাম আঞ্জুমান নিসা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহী খান খাদিম ১৯৪৮ ব্রাহ্মণবাড়িয়া’র জর্জ এইচ স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণীতে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ হতে ঢাকা বোর্ড হতে প্রথম শ্রেণীতে ১১তম স্থান নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এর পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন সম্মান শ্রেনীতে। ছাত্রাবস্থায় খান খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বিএসসি(সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান লাভ করে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৫৪ সালে এম.এস.সি পাশ করেন ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান লাভের মাধ্যমে।
কর্মজীবন
তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর উপর আগ্রহ থাকায় খান খাদিম কোয়ান্টাম থিওরীর উপর পি.এইচ.ডি. করতে যান পশ্চিম জার্মানির গোটেনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬০ সালে ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৫১ থেকে ৩০ জুন,১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ফিলিপস ইলেক্ট্রিক্যাল কোম্পানিতে এক্স-রে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে খান খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৬৩ সালের ২০ অগাস্টে অস্থায়ী প্রভাষক পদে যোগ দেন। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর একই বিভাগে বিভাগীয় ফেলো হিসেবে যোগদান করেন।পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্থায়ী প্রভাষক হিসেবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথমদিকে বি.এস.সি. ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ক্লাশ নিতেন খান খাদিম ।
মৃত্যু
শিক্ষক থাকাকালীন অবস্থায় খান খাদিম থাকতেন তৎকালীন ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ্ হল) ওয়েস্ট হাউজের বাবুর্চি খানার উপর ২য় তলায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতেও তিনি একই ভবনে অবস্থান করছিলেন।প্রতক্ষ্যদর্শীর ভাষ্যমতে,২৬ মার্চ সকালে যখন পাকিস্তানী বাহিনী চানখাঁর-পুল এলাকা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতে চায়, তখন প্রথম প্রতিরোধটি আসে শহীদুল্লাহ হল থেকেই। এতে পাক-হানাদার বাহিনী সরাসরি আক্রমণ চালায় শহীদুল্লাহ্ হলের অভ্যন্তরে। মুহূর্তেই মারা যায় শহীদুল্লাহ্ হলের নাম না জানা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এবং দুজন আবাসিক শিক্ষক। সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে হানাদার বাহিনীর গুলিতে মারা যান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অকৃতদার এই শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদিম। এছাড়াও শহীদ হন গণিত বিভাগের শিক্ষক শরাফত আলী। ১০-১১ দিন লাশ একই অবস্থায় পড়ে থাকার পর গলিত,পচে যাওয়া লাশ নিয়ে যাওয়া হয় দাফনের জন্য।
স্মৃতি
খান খাদিমের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের মাইনর ল্যাবটির নামকরণ করা হয় “খান খাদিম ল্যাবরেটরী”, যেখানে প্রথম তিনি শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পাঠদান শুরু করেন। এছাড়া, শহীদুল্লাহ্ হলের আবাসিক এই শিক্ষকের স্মরণে শহীদুল্লাহ্ হল ডিবেটিং ক্লাব খান খাদিমের নামকরণে প্রতি বছর আয়োজন করে "খান খাদিম অন্তঃহল বিতর্ক প্রতিযোগিতা"। এছাড়া শহীদুল্লাহ্ হলের ওয়েস্ট হাউজের কাছাকাছি ২৫ মার্চ রাতের শহিদ শহীদুল্লাহ্ হলের আবাসিক শিক্ষকদের একটি নামফলক থাকলেও ২০০৭ সালে তা সংস্কারের নামে সরিয়ে ফেলা হয়, যা পরবর্তীতে আর পুনঃস্থাপন করা হয় নি।