হিসাববিজ্ঞান

হিসাববিজ্ঞান হল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যবসায় বা সংঘবদ্ধ দলের আর্থিক ও অনার্থিক তথ্য পরিমাপণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও যোগাযোগের মাধ্যম। আধুনিক শাখাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বেনেডিক্ট কটরুলজেভিক কর্তৃক ১৪৫৮ সালে, (ইতালিয়ঃ বেনেদেত্ত কট্রুগি; ১৪১৬-১৪৬৯), ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, কুটনীতিক এবং মানবসেবী দুব্রভনিক (ক্রোয়েশিয়া) এবং ইতালিয়ান গণিতবিদ লুকা প্যাসিওলি ১৪৯৪ সালে ব্যবসায়ের ভাষা হিসেবে স্বীকৃত, হিসাববিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কর্মকান্ডের ফলাফল পরিমাপ করে এবং এই তথ্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারকারী, যেমন – বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা, ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দিয়ে থাকে। হিসাববিজ্ঞান চর্চাকারীগণকে হিসাববিদ বলা হয়। হিসাববিজ্ঞানআর্থিক প্রতিবেদন করণ প্রায়শই সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

পণ্য ক্রয়, বিক্রয়, মজুদকরণ, হিসাব নিকাশ, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ ব্যবসায়ের অন্যান্য হিসাব সংরক্ষনের জটিল এবং ক্লান্তিকর কাজগুলো আজকাল কম্পিউটার সফটওয়্যারের সাহায্যে অনেক দ্রুততার সাথে করা যায়। এই সফটওয়্যারগুলো সচরাচর প্রত্যেকটি প্রধান কার্যক্রমের সাথে অন্তর্নিহিতভাবে সংযুক্ত থাকে; এতে করে একটি তথ্য প্রবেশ করালে তা সমস্ত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এই সফটওয়্যারগুলো দিয়ে একজন কর্মী প্রায় ২০০ মানুষের কাজ একাই করে ফেলতে পারে। এই ধরনের একাউন্টিং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের কাজ অনেক সহজ করে দেয় এবং এতে করে পণ্য ও সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং অর্থ সাশ্রয় হয়।

হিসাববিজ্ঞান প্রায় হাজার বছর ধরে চর্চিত একটি বিদ্যা। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় উৎপাদিত ফসল এবং মন্দিরে সংগৃহীত শস্যের হিসাব রাখার জন্য হিসাববিজ্ঞানের প্রাচীনতম পন্থাগুলো ব্যবহৃত হতো।

হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি

এই বৈজ্ঞানিক হিসাবশাস্ত্রের প্রচলন করেছিলেন ইতালীয় রেনেসাঁর গণিতজ্ঞ ও ধর্মযাজক লুকা প্যাসিওলি। লুকা প্যাসিওলি ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’র একজন নিকটতম বন্ধু ও গৃহশিক্ষক এবং ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর সমসাময়িক। লুকা প্যাসিওলির ১৪৯৪ সালের মূলপাঠ ল্যাটিন ভাষায় (ট্রেক্সট্) (summa de Arithmatica Geometria,proportionet proportionalita) সুম্মা ডি এরিথিমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরসোনিয়েট, প্রোপোরসনালিটাতে এই প্যাসিওলি বর্ণনা করেছিলেন দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতি যেটা নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক তথ্য রেকর্ড করা হয় দক্ষতার সাথে এবং যথাযথভাবে। লুকা প্যাসিওলির স্বর্ণসূত্র দ্বারা খুব সহজেই সম্পদ, দায়, আয়, ব্যয় এর ডেবিট-ক্রেডিট নির্ণয় করা যায়।[1] [2]

ইতিহাস

অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষ লেনদেনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ও বিভিন্নভাবে তা সংরক্ষণের উপায় বের করে । দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রাচীন গুহা থেকে উদ্ধারকৃত কিছু লিপি থেকে বোঝা যায় যে প্রায় ৭৬,০০০ বছর আগেও মানুষ হিসাব সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল হিসাব বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন।

হিসাব বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলি পাওয়া যায় ব্যাবিলনিয়, এশিরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতায়। এই সভ্যতাগুলো প্রায় ৭,০০০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়া নদীর তীরে গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে। উক্ত সভ্যতার লোকেরা শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদন পরিমাপ করতেই হিসাবের আদিম পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করত। সেই আদিম পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ফসল গত বছরের তুলনায় কম হয়েছে না বেশি হয়েছে তা নির্ণয় করা যেতো। উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ মন্দিরে দান করতে হতো। আর কে কতোটুকু দান করল মন্দির কর্তৃপক্ষ তা দেওয়ালে চিহ্নের মাধ্যমে লিখে রাখতো। এই প্রাচীন দেওয়াল খোদাইগুলোকেও হিসাব বিজ্ঞানের প্রাচীন প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে।

শ্রেণীভাগ

আর্থিক হিসাববিজ্ঞান

নিম্ন ও উচ্চ মূল্যহ্রাস ও মূল্যবৃদ্ধিকালে নামমাত্র আর্থিক এককে (ঐতিহাসিক ব্যয় হিসাববিজ্ঞান বা ঐব্যয়হি) কিংবা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদনের নীতিমালা (International Financial Reporting Standards) অনুযায়ী অত্যুচ্চ মূল্যবৃদ্ধিকালে ধ্রুব ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন এককে (ধ্রুব ক্রয়ক্ষমতা হিসাববিজ্ঞান বা ধ্রুক্রয়হি) অর্থায়িত মূলধন রক্ষণাবেক্ষণকে আর্থিক হিসাববিজ্ঞান বলা হয়। আর্থিক হিসাববিজ্ঞান ঐব্যয়হি বা ধ্রুক্রয়হি অনুসারে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্যাবলির প্রতিবেদন তৈরি করে তা বহিঃস্থ ব্যবহারকারীদের, যেমন বিনিয়োগকারী, পরিচালকবৃন্দ এবং সরবারহকগণের নিকট উপস্থাপন করার উপর গুরুত্বারোপ করে। এটি সর্বজনগ্রাহ্য হিসাববিজ্ঞান নীতিমালা বা সহিনী (Generally accepted accounting principles or GAAP) অনুসারে বহিঃস্থ ব্যবহারকারীদের জন্য ব্যবসায়িক লেনদেন পরিমাপ ও সংরক্ষণ এবং আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে থাকে।[3] সহিনী তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক হিসাববিজ্ঞানের মধ্যকার বৃহৎ মতৈক্য হতে ধারাবাহিকভাবে উৎপন্ন হয়েছে, যা সিদ্ধান্তপ্রণেতাদের প্রয়োজনানুযায়ী কালক্রমে পরিবর্তিত হয়।[4]

আর্থিক হিসাববিজ্ঞানের সাহায্যে সাধারণত বাৎসরিক বা অর্ধবাৎসরিক সময়ের ভিত্তিতে কোনো প্রতিষ্ঠানের পূর্বকালীন প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। যেমন, ২০০৬ সনে প্রস্তুতকৃত আর্থিক বিবরণী বর্ণনা করবে ২০০৫ সনের আর্থিক অবস্থা।[3]

ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান

ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান সে সকল তথ্যাদি পরিমাপণ, সংরক্ষণ ও বিবরণের উপর গুরুত্বারোপ করে যেগুলি ব্যবস্থাপকদেরকে তাদের প্রতিষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞানে ব্যয়-উপযোগিতা বিশ্লেষণ অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ হিসাবনিকাশ ও বিবরণী তৈরি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সহিনী অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক নয়।[3]

ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান ভবিষ্যৎ সময়ের জন্য বিবরণী প্রস্তুত করে থাকে, যেমন ২০০৬ সনের বাজেটটি ২০০৫ সনে প্রণয়ন করাটা এ ধরনের হিসাববিজ্ঞানের কাজ। এক্ষেত্রে, সময়ের পরিসীমা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এরূপ বিবৃতিতে আর্থিক ও অনার্থিক, দু'ধরনের তথ্যই থাকতে পারে এবং উদাহরণস্বরূপ বিশেষ কোনো পণ্য বা বিভাগের উপর গুরুত্বারোপ করা হতে পারে।[3]

নিরীক্ষণ

অন্যের দ্বারা সুনিশ্চিত উক্তি ও দাবির সত্যপ্রতিপাদনকে নিরীক্ষণ বলে। এ কাজটির প্রতিদানে নিরীক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্মানী প্রদান করা হয়ে থাকে।[5] হিসাববিজ্ঞানের ধারণায় নিরীক্ষণ হলো "কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীর পক্ষপাতহীন পরীক্ষণ ও সংখ্যাত্মক পরিমাপণ।"[6]

আর্থিক বিবরণীর নিরীক্ষার লক্ষ্য হলো আর্থিক বিবরণীটির সম্পর্কে স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতিমূলক মন্তব্য প্রকাশ করা। আর্থিক বিবরণী যে সুষ্ঠুতার সাথে সহিনী অনুযায়ী ও "সকল দ্রব্যবাচক দিক" হতে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা, কার্যফলাফল, ও নগদ অর্থপ্রবাহ প্রকাশ করে, একজন নিরীক্ষক সেটি সম্পর্কে অভিমত দিয়ে থাকে। নিরীক্ষককে সে সকল ক্ষেত্রসমূহও শনাক্ত করতে হয় যে সকল ক্ষেত্রগুলিতে ধারাবাহিকভাবে সহিনী মেনে চলা হয় নি।[7]

হিসাববিজ্ঞান তথ্য ব্যবস্থা

কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক তথ্য পদ্ধতির যে অংশটি বিশেষভাবে পরিমাণবাচক তথ্য প্রক্রিয়াকরণের উপর গুরুত্বারোপ করে তাকে হিসাববিজ্ঞান তথ্য ব্যবস্থা বলে।[8]

হিসাববিজ্ঞানের তথ্য ব্যবস্থায় দুটি পক্ষ জড়িত থাকে; তথ্য প্রস্তুতকারী এবং তথ্যের ব্যবহারকারী। হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায়ের ভাষা হিসেবে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট পক্ষের নিকট তথ্য সরবরাহ কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় বর্তমানে হিসাববিজ্ঞানকে একটি তথ্য ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। হিসাববিজ্ঞান তথ্যের ব্যবহারকারী ২ ধরনেরঃ

  • অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারী: যারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও মালিকানার আওতাভুক্ত তাদেরকে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারী বলা হয়।
  • বাহ্যিক ব্যবহারকারী: যারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত কিন্তু মালিকানা এবং ব্যবস্থাপনার অংশ নন তাদেরকে বাহ্যিক ব্যবহারকারী বলা হয়; যেমনঃ পাওনাদার, কর কর্তৃপক্ষ, সরকার, নিরীক্ষক প্রমুখ।

আরো দেখুন

  1. হিসাববিজ্ঞান তথ্য ব্যবস্থা
  2. সর্বজনগ্রাহ্য হিসাববিজ্ঞান নীতিমালা
  3. লুকা প্যাসিওলি

হিসাববিজ্ঞানে ভ্রম

হিসাববিজ্ঞানে ভ্রম হলো হিসাববিজ্ঞানের এন্ট্রি জালিয়াতির সাথে বিভ্রান্ত করা উচিত নয়, যা এন্ট্রিগুলি আড়াল বা পরিবর্তন করতে ইচ্ছাকৃত কাজ করে।

তথ্যসূত্র

  1. Accounting Principles ninth Edition, Page No:5; Author- Viz: Weygandt, Kimmel, Kieso; Publisher- John Wiley & Sons, Inc
  2. মোঃ আবু ওমর,বি.বি.এ.(হিসাববিজ্ঞান),চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
  3. Horngren, Charles T.; Datar, Srikant M.; Foster, George (২০০৬), Cost Accounting: A Managerial Emphasis (12th সংস্করণ), New Jersey: Pearson Prentice Hall
  4. Needles, Belverd E.; Powers, Marian (২০১৩)। Principles of Financial Accounting। Financial Accounting Series (12 সংস্করণ)। Cengage Learning।
  5. Baiman, Stanley. 1979. “Discussion of Auditing: Incentives and Truthful Reporting.” Journal of Accounting Research 17: 25–29.
  6. "Audit Definition"Investopedia। Investopedia US। ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৩
  7. "Responsibilities and Functions of the Independent Auditor" (PDF)AICPA। AICPA। নভেম্বর ১৯৭২। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৩
  8. "1.2 Accounting information systems"Introduction to the context of accounting। OpenLearn। সংগ্রহের তারিখ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

বহিঃসংযোগ

অপারেশন গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস ওয়েবসাইটে

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.